শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

।। ধারাবাহিক উপন্যাস : তপোভাগ ।। সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় ।।





তপোভাগ সপ্তম পর্ব : উদর


চোখ খুলতেই বেগ এলো নাকি বেগ আসাতে চোখ খুললো? বেশ কিছুদিন পর! এমন হয়নি অনেকদিন। তরল বেগ তো আসেই, নিয়মিতভাবে, বরং বেশিই আসে, তরলেরই রাজত্ব, তরল বেগই রক্তের চলাচলে ভূমিকা নেয়। যে বেগ তরল নয়, আজ তার দিন। আজ, অনেকদিন পর। এমন দিনে শরীরের জন্য আনন্দ হয়, রক্তমাংসের আনন্দ। পরিপূর্ণ নিটোল একটি শরীর, সে স্বাভাবিক ছন্দে ক্রিয়া করছে, পঞ্চভূতের প্রত্যেকটিকে এ শরীর নিচ্ছে। দিচ্ছে সকলকে। রক্তমাংসের সঙ্গে পৃথিবীর বন্ধুত্ব। মাটির সঙ্গে, জলের সঙ্গে। নিজেকে নবীন মনে হয়, বিশ্বকে বড়ো আপন মনে হয়।
  চিন্তা করে সময় পার করার অবকাশ নেই এখন। যা করতে হবে, অতি দ্রুত। বেশিক্ষণ ধারণ করা যাবে না, এমনিতেই অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। দ্রুতপদে কুটির থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। হাঁটতে লাগলেন। কয়েক মুহূর্ত পর, জলাশয়টি দেখা যাচ্ছে যখন, তিনি বেছে নিলেন পাশাপাশি দুটি গাছ, যাদের মধ্যে দুইহস্তপ্রমাণ ব্যবধান, তাদের মধ্যেখানের অংশটি ঈষৎ ঢালু। গাছ দুটির পশ্চাতে, ঢালু অংশটির উপর নিতম্ব ঝুলিয়ে, বস্ত্র কোমরের ওপর তুলে নিয়ে বসে পড়লেন দ্রোণ। তারপর মুক্ত করে দিলেন নিজেকে। শরীর তার ক্রিয়া করতে থাকলো।
  গতকালের সন্ধ্যায় ভোজন হয়েছিল পূর্ণমাত্রায়। স্থালীভরা সুস্বাদু ভোজ্য, তার আগে ও পরে মাধধ্বীক। ঔদরিক সুখ। এখন সেই সুখের ফল প্রকাশ হচ্ছে, ফের ফিরে যাচ্ছে প্রকৃতিতে। আরও সময় লাগবে। ভারসাম্য স্থির করে আরো ভালোভাবে বসলেন দ্রোণ। একটি কাঠবিড়ালি ঘোরাঘুরি করছে, কয়েকবার তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে তার দিক থেকে কোন আক্রমণের আভাস না পেয়ে তার পাশ দিয়ে পেরিয়ে গিয়ে বামপার্শ্বের গাছটিতে উঠলো। একটু ওপরেই একটি কোটর, কিন্তু সেটিতে সে একবার উঁকি মারলো মাত্র, তাতে ঢুকলোনা। আরও উপরে হয়তো ওর বাসা।
 কোটরটি গুহার আকৃতির। কেউ কখনো এতে আগুন জ্বেলেছিলো, কোটরটি, তার মুখটি একেবারে কালো হয়ে আছে। সত্যিই গাছের কোটরগুলি কেমন বিচিত্র আকৃতির হয়! সৌভঞ্জন গাছ হলে যেমন, তাতে কোটর হবেই, আর সেই কোটর অবশ্যই হবে যোনিচিহ্নের মতো আকৃতির। দ্রুপদ প্রথম তাকে চিনিয়েছিলো, যোনি বস্তুটি ওপর থেকে ঠিক কিরকম দেখতে হয়। তার আগে মানুষীযোনি কেমন দেখতে হয়, সে বিষয়ে না ছিলো তার আগ্রহ, না ধারণা! সমস্ত স্ত্রীপ্রাণীরই যোনি থাকে, মানুষেরও থাকবে, এ নিয়ে রোমাঞ্চিত হবার কি আছে, এমনই ছিলো তার ভাবনা। দ্রুপদ কিনা রাজপুত্র, অস্ত্রবিদ্যা শিখতে আসবার আগেই সে মানুষীযোনি চিনে ফেলেছিলো। সে চেনাবার পর, একলা কখনো অমন যোনিচিহ্নিত কোটরের সামনে পড়ে গেলে দ্রোণের অকস্মাৎ মনে হয়েছে, আরেঃ, এই সেই যোনিচিহ্ন? একলা, হ্যাঁ, রোমাঞ্চিত হয়েছে সে।
  দ্রুপদ আর তার একবার প্রতিযোগিতা হচ্ছিলো ধনুর্বিদ্যার। প্রতিবার দ্রুপদ পরাজিত হচ্ছে, অস্বস্তি এড়াতে সে লক্ষ্যবস্তু পালটে দেয়, যেন বড়ো পাথরের ওপরে রাখা ছোট পাথরটিতে তীর মারতে সে ঠিক উল্লাস বোধ করছেনা। তারপরই সে এমন এক সৌভঞ্জন গাছের যোনিচিহ্নের কোটরে লক্ষ্য স্থির করে। দুরত্ব কমিয়ে দেওয়া হয় এবং স্থির করা হয় যে কোটরের ফাঁক দিয়ে ঢুকে তীর যেন অপরদিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। শরের পশ্চাতের পালক খুলে নিয়েছিলো দুইজনেই।  বারবার দ্রুপদ পরাজিত হচ্ছিলো বলে দ্রোণ এবার তাকে ছেড়ে দিতে চাইছিলেন। প্রথমে শরক্ষেপ করলো দ্রুপদ, কোটর ভেদ করে বৃক্ষকাণ্ডটির অপর দিক দিয়ে  বেরোলো সত্যিই, কিন্তু সম্পূর্ণ বেরোলো না। অর্ধেক বৃক্ষটির ওপারে এবং বাকি অর্ধেক কোটরের মধ্যে হয়ে এপাশে তার শেষাংশ দেখা যাচ্ছিলো।
দ্রোণ পূর্ণশক্তি প্রয়োগ করলেন না, তার তীর ঠিক কোটরের নিচে যোনিচিহ্নে বিদ্ধ হলো এবং পড়ে গেল।
স্বভাবতঃই দ্রুপদ উল্লসিত, দুইজনে এগিয়ে এসে যখন তাদের শর বৃক্ষ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছিলো, দ্যাখা গেল, যে স্থানে দ্রোণের তীর এসে লেগেছিলো সেখান থেকে রস গড়িয়ে নামছে!
দ্রোণ টের পেলেন, তাঁর পুরুষাঙ্গ সম্পূর্ণ উত্থিত হয়েছে। মলত্যাগ সম্পূর্ণ হয়েছে তাঁর, কানদুইটির কাছে গরম ভাব, উপস্থে টনটনানি। পুরুষাঙ্গটিকে সযত্নে ধরে উঠে দাঁড়ালেন দ্রোণ। তাঁর পুরুষাঙ্গটি একটু বেশিই দীর্ঘ, পূর্ণ উচ্ছ্ব্রিত অবস্থায় অন্যরকম নড়াচড়ায় সেটির মূলে টান লাগে, সেইকারণে বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময় সেটিকে সাবধানে ধরতে হলো। নির্জন অরণ্যপ্রায় প্রকৃতি, জলাশয়, মনুষ্য ধারেকাছে কেউ নেই, পরণের বস্ত্রটি বামহাতে খুলে ফেললেন দ্রোণ, দক্ষিণহস্তটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিনি ক্লেশ বোধ করছেন, মুঠোয় ধরা অঙ্গটিকে তার প্রাপ্য মিটিয়ে দিতে হাত ছটফট করছে।
  চাঁদের মতো সেই নারী, করভা। তার কথা মনে পড়লে মনে বর্তুল আভাস আসে।   অগ্নিবেশ্য মুনির আশ্রমের সেই নারী। করভ মুনির পত্নী, সে নাকি হারিয়ে যাওয়া এক অপ্সরাকন্যা তাই তাকে করভা বলেই ডাকতো সবাই, করভ মুনি অগ্নিবেশ্য মুনির একজন অনুগামী, সেই করভা এখন কেমন আছেন?
এই নারীটিকে দেখে বোঝা যায়, কেন চাঁদের সঙ্গে তুলনা করা হয় নারীর। প্রায় গোলাকার মুখমণ্ডল, বাকি সর্বাঙ্গে বর্তুল আকার সবার প্রথমে নজরে পড়ে। কিন্তু অদ্ভূত তার শারিরীক সংস্থান। হাতের মুষ্ঠি কি কোমল তার, ঈষৎ ঘর্মাক্ত করতল পুষ্পসম, অথচ  নিতম্বদ্বয় কঠিন, উন্নত ও দৃঢ, পাথরের মতো স্তন। অপ্সরার মেয়ে বলেই কি অমন? অপ্সরাদের কি অমনই হয়?
চলবার সময় করভার উরুদুইটি পরস্পর ঘর্ষিত হতো। রক্তাভ শ্বেত গাত্রবর্ণের নারী, উরুর ভেতরের দিকের ওই ঘর্ষিত অংশে একটি রক্তাভ ভাব থাকতো। দন্তধাবনকাষ্ঠের খোঁজে বনমধ্যে একাকী ঘুরছিলেন দ্রোণ, ঝুঁঝকো সকাল, রাত্রির তন্দ্রাজড়িমা কাটেনি তখনো, ঘনসন্নিবদ্ধ গুল্মরাজির মধ্যে সংকীর্ণ পথ। সেই গুল্মরাজির শেষে মনুষ্যপ্রমাণ ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটি রেখা হয়ে আসছিলো সে, কোমরে কলসী, তখনো ভরা হয়নি। কাছে এসে দ্রোণকে চিনতে পারে, মৃদুহাস্যটি পাশকাটিয়ে যাবার সময় গুল্মে বেধে যায় নীবিবন্ধ, ভারসাম্য টলে যায় করভার। কলসী সামলাতে গিয়ে তা আরো আলগা হয়, বস্ত্র ধরতে গিয়ে আবার ভারসাম্য স্খলিত হয় এবং কলসী কক্ষচ্যুত হয়।  তারপর বস্ত্রও। বস্ত্র মাটি থেকে তুলে দিতে গিয়ে চোখের উচ্চতায় দ্রোণ করভার উরুর সেই রক্তাভ অংশ দ্যাখে, তারপর সে হাত দেয়? নাকি তার হাত স্বাধীন? সম্ভবতঃ তার হাত স্বাধীন। তার মনে আছে, স্পর্শ করবো, এমনটা ভাববার আগেই সে লক্ষ্য করেছিলো, তার হাত সেই স্থান স্পর্শ করছে, কুসুমাদপি পেলব সেই স্থান স্পর্শ করে তার রোমাঞ্চ ছাপিয়ে যাচ্ছে বিস্ময়, করভা দুই উরুর মাঝে হাত রেখে শরীর বাঁকিয়ে নিয়েছে, ঢেকে ফেলছে সেই রক্তাভ অঞ্চল। করভার দুই জানু ধরে  বিস্মিত ও উৎসুক মুখ উর্ধ্বে তুলে থমকে তাকিয়ে ছিলো দ্রোণ, নতজানু। করভার বাঁকা শরীর লীলায়িত হলো ফের, দ্রোণের মাথায় হাত রেখেছিলো সে এরপর। দ্রোণ ওই স্থানে এরপর ঠোঁট রাখে। করভার শ্বাস ঘন হয়।
 অথচ নিতম্ব ছিলো তার কঠিন, স্তন পাথরের মতো শক্ত তার। বাকি সমস্ত অঙ্গে যাওয়া হয়নি, তখন ছিলো ব্রহ্মচর্যকাল।
ওঃ করভা, করভা, তার পুষ্ট ওষ্ঠপুট, তার বর্তুল ভারী স্তন, তার মুখের ভেতরের আমিষগন্ধ...
ক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হলে শিথিলতা শরীরে আসে, মনেও। এক অন্যমনস্ক উদাসীন ভাব, একটু বিষণ্ণতাও লেগে থাকে মনের শরীরে।


                                        
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhi95qfXbdwjYNLtRm2Y0PrOJucxSEqT6jOhpp2sFUEVJDs43CDfKjKBE3Rw27-2iD85i9wi5gsC8DBn5ITnZEV3hivCEiXHJN1UTHVgkklhTVioKfms_m9pkpmgNPPSf4FBvC-Idl1uUA/s640/tapobhag.jpg
চিত্রঋণ : দয়িতা সরকার


দ্রুপদকে মনে পড়ে খুব। বন্ধু সে হৃৎস্পন্দন! অগ্নিবেশ্য মুনির আশ্রমে সেইসব দিন। দ্রুপদ রাজপুত্র বলে অনেক কিছুই জানতো, শুধু জানতোনা খিধে জিনিসটা কেমন। আশ্রমে এসে সে প্রথম ক্ষুধা অনুভব করেছিলো। ক্ষুধার উদ্রেকের আগেই খাদ্য এসে যাবার রাজপুরী থেকে সে এসে পড়েছিলো বনমধ্যে অস্ত্রবিদ্যা শেখার আশ্রমে। এই তো সেদিন, দ্রোণ স্পষ্ট মনে করতে পারেন, প্রাত্যহিক অভ্যাসের শেষে যখন তাদের দুজনকে বাকি আশ্রমিক শিষ্যদের নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন মুনিবর, সেই সকালের শ্রমদানের জন্য, দ্রুপদই সবার আগে বসে পড়ে। ক্লান্ত হয়। দ্রোণ তাকে ধরে তুলতে গেলে ক্রুদ্ধ হয়ে সে ছিটকে উঠে পড়ে। হেসে, গায়ে হাত বুলিয়ে, শান্তস্বরে কথা বলে দ্রোণ জানতে পারে, তার আসল সমস্যা হলো ক্ষুধার অবসন্নতা। হেসে ফেলেছিলো দ্রোণ। নৃপতিনন্দন ক্ষত্রিয় জানেনা, ক্ষুধা কি! ব্রাহ্মণকে জন্ম থেকে জানতে হয়। খাদ্যের বিকল্পে জল ব্যবহার করতে এই ক্ষত্রিয়সন্তান শেখেনি! অত্যন্ত স্নেহ বোধ করেন তার প্রতি দ্রোণ। আহা, বেচারা অবুঝ ক্ষত্রিয়সন্তান!
   তারপর তো হৃদ্যতা। সব শিষ্যের চেয়ে অধিক দক্ষ হয়ে ওঠেন তারা দুইজন। সুবিশাল দেহকাণ্ড দ্রুপদের, শরীরে প্রমত্ত বল তবু তার বাণ ততো ভেদশক্তি অর্জন করেনা, যতোটা করতে পারে দ্রোণের বাণ। দ্রুপদ অবাক হয়ে যায়। মল্লযুদ্ধে সে দ্রোণকে পরাস্ত করে সহজেই, যদিও এই আশ্রম মল্লযুদ্ধ শিক্ষার নয়, তারা ক্রীড়াকৌতুকে তা অভ্যাস করে, অথচ দ্রোণের বাণ যেরূপ নিশিত, তার বাণ তেমন হয়না কেন? দ্রোণ মৃদু হাসেন। শরক্ষেপণের খুঁটিনাটি শিখতে দ্রুপদকে কিছু কিছু সাহায্য করেন, অনেককিছুই গোপন করে রাখেন। গুরুর দেওয়া বিদ্যার সঙ্গে নিজের প্রতিভা যোগ করে তিনি যেখানে পৌছোন, তা তাঁর নিজের অর্জন। তা এমনি এমনি কাউকে দিয়ে দেওয়া যায় না।
   বাকি সকলের থেকে তবুও, দ্রুপদই তার কাছের হয়ে ওঠে। যুদ্ধবিদ্যা নিয়ে তাদের আলোচনা হয়, আশ্রমটি গঙ্গানদী থেকে অল্প দূরে, এই স্থানে নদী অবধি পাঞ্চালরাজ্যের সীমা। অগ্নিবেশ্য মুনির আশ্রমে অন্য অন্য রাজ্য থেকেও শিষ্যেরা আসে। পশ্চিমে গান্ধার, মদ্রদেশ, পূর্বে মগধ, প্রাগজ্যোতিষ ও পৌণ্ড্রবর্ধন থেকেও শিষ্যেরা আসে। রাজনীতি নারী আর যুদ্ধবিদ্যা -- দ্রুপদের প্রিয় আলোচ্য বিষয় এই তিনটি। রাজ্য পেলে সে আগে তিন চারটি পুত্র উৎপাদন করে ফেলবে, তারপরেই দিগবিজয়ে বেরোবে। উত্তর পূর্বে কিরাত দেশ, তার আগে পার্বত্য অঞ্চল, সেসব এখনো অজেয় পড়ে রয়েছে, দ্রুপদ চায় সেদিকে রাজ্য বাড়াতে। সে দ্রোণকে চায়। দ্রোণ যদি তার সঙ্গে থাকে, সে পৃথিবী জয় করতে পারে। নতুন জিতে নেওয়া সেই পার্বত্যভূমি এবং কিরাতদেশে সে নিজে রাজত্ব করবে, তার পাঞ্চালরাজ্য ছেড়ে দেবে সে দ্রোণকে। দ্রোণ রাজত্ব করলে সেটা তো দ্রুপদেরই রাজত্ব করা। শুধু, প্রত্যেকটি যুদ্ধের সময় দ্রোণকে পাশে চাই তার। দ্রোণকে বিশেষ কিছু করতে হবে না, বন্ধুর সঙ্গে থাকলেই হবে।
দ্রুপদ এখন কেমন রাজত্ব চালাচ্ছে কে জানে! কয়টি পুত্রই বা উৎপাদন করলো সে ইতিমধ্যে? কিরাতদেশ জয় করতে সে বেরোয়নি, বেরোলে খবর পাওয়া যেতো। দ্রুপদের সমস্ত সংবাদ সে জানতেই পারতো পিতা এখন জীবিত থাকলে। পিতার কাছে নানাদেশের মুনি, তাপস ও পরিব্রাজকেরা আসতেন। কিছু না হোক, নানাদেশের সংবাদ পাওয়া যেতো। পিতার মৃত্যুর পর তাঁরা আর আসেননা। দ্রোণের সঙ্গে তাঁদের আধ্যাত্মিক আলাপ জমেনা, হোমাগ্নিতে ঢালবার মতো ঘি দ্রোণের কাছে নেই আর পারমার্থিক তর্কে দ্রোণ তাঁদের মতো সুখবোধও করেননা, তাঁদের সঙ্গ দিতে পারেননা। তারা ক্রমে ক্রমে এদিকের পথ পরিত্যাগ করেছে।
     এ বিশাল বিশ্বে দ্রোণ একা। প্রত্যেকদিন ঘুম থেকে উঠেই খাদ্যচিন্তা করতে হয়।
  হ্যাঁ, কারো অতিথি হলে খাদ্য নিয়ে ভাবতে হয়না, এটা ঠিক। মানুষ নিজে না খেয়েও অতিথিকে অভুক্ত রাখেনা। কিন্তু প্রত্যহ এর ওর অতিথি হতেই বা কার ভালো লাগে! যজনযাজনের ক্রিয়াবিধি দ্রোণ জানেন সব, ব্রাহ্মণের ছেলে, পিতৃদেব যত্ন করে শিখিয়েছিলেন কিন্তু ওসব কর্মে তাঁর আগ্রহ নেই। যজ্ঞবেদীর আকার নির্ধারণ, তাতে ঘৃত অথবা সোম অর্পণ করে ইন্দ্রাদি দেবগণের আবাহন -- এসব কার্য দুয়েকবার করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন, তিনি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন।
আর, কেনই বা তিনি করবেন ওইসব। যজনযাজন নয়, অস্ত্রবিদ্যায় তাঁর মনপ্রাণ সঁপে রাখা আছে। যা তাঁর আগ্রহের বিষয় নয়, তাতে তিনি কেন নিজের জীবনকে বেঁধে ফেলবেন? তিনি অদ্বিতীয় ধনুর্ধর, সর্বাস্ত্রবিদ, তিনি তো ইচ্ছে করলেই কোন নরপতির সেনাদলের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করতে পারেন। অথবা হতে পারেন কোন নূতন ভুখুণ্ডের অধিপতি।
   নরপতি, ভূপতি,  রাজন্। মহারাজ বলে সম্বোধন করবে তাকে লোকে? নাকি রাজন্? ব্রাহ্মণকূলে জন্ম নিয়ে নৃপতি হবেন তিনি? তাতে কি? এমন তো কতোই হয়েছে! ব্রাহ্মণ হয়েছে রাজ, ক্ষত্রিয় করেছে তপস্যা। মৌদগল্যায়ন ব্রাহ্মণ যাঁদের বলা হয়, তাঁরা কি? রাজ্যভাগ ছেড়ে দিয়ে সপরিবারে তপোব্রত গ্রহণ করা ক্ষত্রিয়ের বংশ তারা।
   যদিও তিনি জানেন, অস্ত্রনৈপূণ্য এক বস্তু, যুদ্ধবিদ্যা আর এক। অস্ত্রনৈপূণ্য বা দৈহিক বল যুদ্ধকালে কাজে লাগে অল্পই, যুদ্ধবিদ্যার মূল কথা হলো সৈন্য সংস্থান, সৈন্য পরিচালনা এবং ব্যূহরচনা। এবং তা করতে হয় বিপক্ষের শক্তি পরিমাপ করে নিয়ে। 
   অগ্নিবেশ্য মুনির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শিষ্য দ্রোণ, কিন্তু কোন যুদ্ধে লড়ার অভিজ্ঞতা নেই তাঁর, সৈন্য পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই। কোন নৃপতি যদি তাকে উপযুক্ত পদ না দিতে চায়?
   নাঃ পদাতি সৈন্য হয়ে জীবন ব্যতীত করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। বরং অরণ্যে বাস করে ফল মূল কন্দ তুলে প্রাণধারণও শ্রেয়ঃ। অগ্নিবেশ্য মুনির শ্রেষ্ঠ শিষ্য পদাতির জীবন, না, অসম্ভব!
    ভূমি চতুর্দিকে অজেয় পড়ে রয়েছে। আপাদমস্তক অরণ্যভূমি, মধ্যে একটি দুটি বিন্দুর ন্যায় জনপদ। সেই জনপদের আশেপাশে খানিকটা ভূমির গাছদের কেটে ফেলে চৌরস করে তৈরি করে নেওয়া কৃষিজমি। সেই জমির পর আবার, যোজন যোজন বিস্তৃত অরণ্য।  বিস্তারিত ভূমি অরণ্য ও জলাশয় বিজিত হবার জন্য পড়ে রয়েছে। হাতে খানিকটা স্বর্ণ থাকলে একটি সেনাদল তৈরি করে রাজ্যপ্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব তো নয়ই, কঠিনও নয় তেমন।
   হেসে ফেললেন দ্রোণ। নিদ্রাভঙ্গ হলেই তার মনে প্রথমে অন্নচিন্তা আসে। রাত্রে নিদ্রা যাবার সময় আশা হয়, আগামীকাল নিশ্চয়ই সুখাদ্য জুটবার কোন না কোন যোগ ঘটবে। সৈন্যদল? রাজ্যপ্রতিষ্ঠা? স্বর্ণ?

হে উদর, শান্ত হও, অতো বেশি মুচড়ে মুচড়ে উঠোনা!


৫টি মন্তব্য:

  1. সাগ্রহে পড়লাম। ভালো লাগলো। অর্ঘ্য দত্ত

    উত্তরমুছুন
  2. এলেখা তোর বই-এর আকার পাক।সু অতি প্রিয়।

    উত্তরমুছুন
  3. কাঠবিড়ালীর উপেক্ষা না আকর্ষণ তা জানা যায় করভার সন্দর্শনে ও উষ্ণতায়

    উত্তরমুছুন
  4. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  5. ১) সুপ্রিয়র এই ধারাবাহিকের শেষের পর্বগুলো কোথায় পাবো ? বাক্ ১৪৩ বা ১৪৪-এর পরে আর দেখছি না।
    ২) সহৃদয় কেউ সাহায্য করবেন ? অথবা যদি এ লেখা বই হয়ে বেরিয়ে থাকে, তাহলে সেই বই কোথায় পেতে পারি, তার সন্ধান যদি দিতে পারেন কেউ।

    উত্তরমুছুন