৯০° এর মাঝে যতটুকু শূন্যতা
যাদের জীবনে অনেক
গেছে, অত্যন্ত তেষ্টাতেও তারা বোতলের নিচে খানিকটা জল বাঁচিয়ে খায়- তা সংকোচ না
সঞ্চয় ধরা মুশকিল। গেছে আমারও, সবচেয়ে বেশি- যা গেছে- অনুভূতি, দুটো পায়ের সমতলে
মাটি ছোঁয়ার অনুভূতি। ক্রমশ সঙ্গীহীন হয়ে এসেছে আমার ডান পা ততোধিক আলাদা হয়ে গেছি, নিজের মধ্যে একা হয়ে এসেছি। কিন্তু আক্ষরিক
অর্থে নিঃসঙ্গ আমি কোনোদিনই নই।
কিছু “যাওয়া” তৃতীয়
নয়ন আর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় উপহার দেয়। কানের পাশের সাঁ সাঁ হাওয়া কাটার শব্দটা যেদিন
থেকে মিলিয়ে এসেছিল, কাঁদিনি। কাঁদার বোধ
আসেনি তখনও। ছোটোবেলায় মানুষ শুধু ব্যথায় বা খিদেয় কাঁদে – হারানোর সুদূরপ্রসারী কষ্ট তখন তাকে ভাবাতে পারে না। দিনে দিনে উডল্যান্ডস ক্যান্টিনের চকোলেট
পেস্ট্রির মাথার চেরিটার সাথে বন্ধুত্ব
বাড়ছিল আর আমি কিতকিত খেলায় তুখোড় হয়ে উঠছিলাম। “ঠিক হয়ে যাবে”- বিশ্বাস করতাম।
তারপর বছরের পর বছর প্রতিটা মাইনাসকে আড়ে লম্বায় সাজাতে সাজাতে বুঝে গেলাম কিছুই
ঠিক হয়না মনের মত করে, ‘ঠিক’-এর সংজ্ঞাটা বদলে
নিতে হয়- শুধু।
ফি রোববার মুরগীকে
মুরগী করার মতই আমিও হয়েছি, বুঝেছি পরে। বেহালার
বালানন্দ- দু’মাস টানা ট্রাকশনের পরে এক সকালে মা বেড থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুব করে
কচি কলাপাতা রঙের একটা সাবান মাখিয়েছিল। লেবুগন্ধে মুরগি হতে হতে বুঝিনি
সেদিনই আমার কাটবে! পাছায় থাপ্পর মেরে একজন নার্স হাসতে হাসতে গুঁজে দিয়েছিল- আর
একজন চামড়ার নীচে কী একটা- জন্মের জ্বালা
করেছিল একটা সদ্য জন্মানো ফুটকিতে। নীল সার্কেল হাতে বসে থাকতে থাকতে বেলা বাড়ল-
জানতে পেরেছিলাম ‘সু-সাইড ক্যান্সেল’-এর মত অপারেশন
ক্যান্সেল। ডাক্তার আসতে পারেনি। বাচ্ছা বয়েস- খুব আনন্দ হয়েছিল। মুরগি হয়েছি আরেকবার, বুঝিনি। সাতদিন পর সকাল থেকে সেম প্রসেস পুনরায় অ্যাপ্লাই
করে প্রথম নেশা করেছিলাম। ক্লোরোফর্মে। জানেন
হয়ত, বুজটা ভীষণ লংলাস্টিং। এই আড়াই মাসে আমি স্যালাইনের বোতল কেটে একটা দুর্দান্ত
ডিজাইনের ফুলদানি বানানো শিখেছিলাম। সেখানে জল ঢেলে আজও বসে। কিন্তু এরপর কেউ আর
ফুল দেয়নি।
ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড
হেলথ- জুনিয়র ডাক্তাররা শিরা খুঁজছে। পূর্ব অভিজ্ঞতায় আঁটি আমি কনুইয়ের খাঁজ
দেখিয়ে বলেছিলাম, “এখানে পাবেন”। সেসবে কান না দিয়ে দুটো হাত মিলিয়ে সাকুল্যে বারো
বার সূচ ফুটানোর পর ওরা আমার বলা জায়গায় আসে এবং পায়! এরপর দীর্ঘদিন সেই চ্যানেল
দিয়ে বুড়িগঙ্গার জলের মত তিরতির করে বয়ে গেছে বিভিন্ন অ্যাম্পুল। ব্লেড দিয়ে শিরা চেরা
জ্বালা নিয়ে হসপিটালের ছাদে মায়ের কোলে ঘুরেছি। দেখেছি ছাদের জায়গায় জায়গায়
পিচচটের তালি –ঠিক আমার পায়ের মতো।
ভেলোরে সাত ঘন্টায় আটাশটা সেলাই, পায়ের গোছে হাড় ড্রিল করে উন্মুখ শিক থেকে ছোট ছোট বালির
বস্তা ঝুলিয়ে রাতকে রাত ট্রাকশন দিত আর আমি চাদর খামচে ঘুমের ওষুধ চাইতাম। দিত না
সবসময়। তখন একটু বড়- খিস্তি শিখেছি! এরপরেরটা আপনারা বুঝে গেলেও যাদের দিতাম তারা
বোঝেনি কারণ ওই ডাইভারসিটি, যাতে ইউনিটি রক্ষিত
হয়। ওই কদিনে আমি একজনকে ভালবেসেছিলাম। আমার যন্ত্রণায় ঝাপসা রাতগুলোয় ওঁর শিফট থাকলে আমার মাথার কাছে বসে বাইবেল পড়ে শোনাতেন। আর আমার
ঠোঁটের চামড়া ফেটে গুটিয়ে গেলে তুলোয় করে একটা ভিজে ভিজে কী এনে যত্ন করে লাগিয়ে দিতেন ঠোঁটে। উনি আনম্যারেড ছিলেন।
একটি সন্তান দত্তক নেন। আমায় কয়েকবার জড়িয়ে ধরেছিলেন। ওঁর অ্যাপ্রনে একটা ঘুম গন্ধ ছিল।
‘সাকসেস’ এরপর এসেও চলে গেছে। আরব কটেজের ব্যালকনিতে শেষবার ওরা
একসাথে মাটি ছোঁয়। বিশ্বাস হচ্ছিল না, ঠাণ্ডা মেঝেতেও এত সুখ! বুকের শ্বাস চোখ
দিয়ে ঠিকরে গেছিল, কেউ জানে না। ব্যালকনির রেলিং চেপে
ধরেছিলাম। খুব নাচ শিখতে ইচ্ছা করেছিল।
আসলে কী জানেন? যাদের এসেও থাকেনি, যারা পেয়েও হারিয়েছে তাদের মত জলতেষ্টা
আর কারও পায়না। তারা শেষপর্যন্ত শেষ করেও খানিকটা বাঁচিয়ে খায়। তা উদারতা না
শূন্যের প্রতি ভয়, বলা মুশকিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন