তৃতীয়
পর্ব
“চ, পানি লিয়ে আসি” বলে
কানুদা পাহাড় থেকে নামতে থাকে হড়বড়িয়ে। বড় বড় পাথরে পা রেখে সে নেমে যেতে থাকে। আমি ‘মহাজনো যে নঃ
গত সঃ পন্থা’...ভেবে তার দেখাদেখি পা ফেললাম, একটা মাঝারি সাইজের গ্রানাইটকে
লক্ষ্য করে, কিন্তু
কোথায় কী! ব্যাটা বিশ্বাসঘাতক পাথর! পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই আমার সমগ্র শরীর
“আকাশে আশ্রয় খুঁজি ডুবিল হতাশ” হয়ে একটি নাতিবৃহৎ উপলখন্ডের সাথে লতাগুল্মবৃক্ষের
উপর ঝড়মড়াৎ শব্দকরতে করতে কানুদার প্রশস্তস্কন্ধের উপর পতিত হইল।
‘আঃলো মারি
ফেলিলা’,বলে কানুদাও মদাঘাতে (বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো)
নিচু পার্বত্য
প্রদেশপানে বোঁটাকাটা কুমড়োর পারা পড়তে লাগল।
হাতের জ্যারিকেন
কোথায় উড়ে পড়ল কে জানে। একটা কোটরা হরিণ ব্বাক্ ব্বাক্ করে ভয়ার্ত চিত্কার করতে
করতে পাশ দিয়ে বিদ্যূতবেগে বেরিয়ে গেল। এ যাত্রা বাঁচার আশা নেই,নীচে পড়লে দুশোফুট
গভীর খাত। প্রায় ৮০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়টার গা বেয়ে গড়িয়ে পড়বারও
উপায় নেই। গড়িয়ে গেলে ৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলেও জান বাঁচানো যায়। এ যে সোজা গবাশ করে
"পড়লি আর জান ছাড়্যে দিলি "।
না, সে যাত্রায় জান
ছাড়তে হয়নি অবশ্য। মিরাক্যাল!
হ্যাঁ,আমার কাছে।
কিন্ত কানুদার কাছে নয়। সে তার শালপ্রাংশু মহাভুজ দিয়ে একটা অজগর সাইজের লতাকে
আঁকড়ে ধরেছে। আমি ধরে আছি তার ঘর্মাক্ত কোমর। তারপর, দোলে দোদূল দোলে দোলনা। জান
হাতে পেয়ে গান গাইব কি না ভাবছি,কানুদার ধমক, নাম্ হারামজাদা, লাগালে উ গাছটার
গড়াটা ধরে লে। গাছের গোড়া ধরে তো কোনরকম দাঁড়ালাম। তখন আমার হাত পা থরথর করে
কাঁপছে।
অনেক কসরত করে আমরা
পাহাড়তলিতে নেমে এলাম।দু'টো পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে বয়ে আসা জলধারার ঝরঝর আওয়াজ পেয়ে
আমরা সে দিকেই এগোলাম। কানুদার চোখের দিকে এখন তাকানো যাবে না। তার চোখ যেন ভাটি
জ্বলছে। বিড়বিড় করে ওড়িয়া বাংলা মিশিয়ে আমাকে বিচিত্র গালাগাল দিতে দিতে সে
এগুচ্ছে। ষড়া,গল্ল্ব, বুঁয়ার। কত কী! এখন যদি প্রতিবাদ করি আমাকে হয়ত তুলে নিয়ে
গিয়ে গল্ল্ব"র পায়েই ফেলে দেবে। ওড়িয়া ভাষায় গল্ল্ব মানে বাইসন।এ জঙ্গলের কোন্ কোনে কোন্ জানোয়ার থাকে
সে শুধু কানুদাই জানে। অতএব নিশ্চুপে শরণম্ কানু ছাড়া গতি নেই।
অনুচ্চ জলপ্রপাতটির
কাছে গিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন অন্ধকার নেমে গেছে। জায়গাটার নাম কান্ডিয়া।
ঝর্ণাধারাটির নাম লুকা। এখন লোকে কান্দালুকা জলপ্রপাত নামেই চেনে। এখানে পাহাড়ের পাথরের গায়ে লোকে বাঁশের নল লাগিয়ে
রেখেছে। তা দিয়েই আসল মিনারেল ওয়াটার নামে। আর মূল যে ধারা, সেটা পশুদের গা ধোয়া
হয়ে ঘোলাটে হয়ে নামছে। সে জল খাবার জন্য নয়।
আশ্চর্য, জল ধরব
কী! আধো-অন্ধকারের মধ্যে গোটা প্রপাতের পাথরজুড়ে ফসফরাস জ্বলছে। যেন অন্ধকারের
মধ্যে ছোট ছোট মশাল জ্বেলে ঘোরাঘুরি করছে একদল লোক, সে এক চলমান আলোর
মেলা বসে গেছে! চোখ ফেরানো যায় না।
আমার হোঁদলের মতো
অবস্থা দেখে কানুদা তাড়া লাগায়,পানি পিবাকি লোক্ ছটফঠাইনছে। তাত্তাড়ি কর্।
ভারতবর্ষে কত
সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। এক প্রদেশের মানুষ আর এক প্রদেশের টানে ছুটে যায়। প্রতিদিন
কত বাস ট্রেন প্লেন যাত্রী নিয়ে ছুটছে মানুষকে তার সৌন্দর্য দেখাবে বলে।
আমরা সে ভারতবর্ষকে দেখি মেকআপ করা অবস্থায়। সে ভারত আর্টিফিশিয়াল ভারত। আর আমার সামনের এই
অন্ধকার ভারতের যে 'সমুজ্বল' সৌন্দর্য(আক্ষরিক অর্থে) উন্মুক্ত, তা কি দিনক্ষন দেখে,
আত্মীয় সমারোহে পয়সা খরচ করে দেখা
যায়!
জ্যারিকেনগুলো
কানুদা পাহাড় হাতড়ে নিয়ে এসেছিল। আমরা সেগুলো ভর্তি করে নিয়ে চললাম পাহাড়ের উপরের
সেই ছোট্ট উপত্যকার দিকে,যেখানে আমাদের ক্যাম্প। আকাশে হালকা একটা বাঁকা চাঁদ
ছিল,আর নক্ষত্রের আলোয় চলতে অসুবিধে হচ্ছিল না। তবু উল্লম্বরেখায়, সাথে জলের ভার নিয়ে হাঁটা একটু কষ্টকর
বটে।কানুদার থেকে তিরিশহাত পিছনে চলেছি আমি। রাস্তায় গোটাকয় খরগোস চোখে পড়ল,পা এর
শব্দে ঝুপঝাপ সরে গেল। কিছুদূর যাবার পর একটা হোঁত ঘোঁত শব্দ শুনে চমকে তাকিয়ে
দেখি বাঁকানো দাঁতওলা একটা শুয়োর রজন গাছের গোড়া তেড়েফুঁড়ে খামআলু বের করে মজা সে
চিবোচ্ছে।
আমি সে দিকে হাঁ
করে চেয়ে আছি দেখে কানুদা বলল, ষড়া পলাইবি ত বাঁচিবি! ই গুয়ার ব্যাটা আঁঠু ল্যে
পেট তক্ব ফাঁড়ি দিব।
তারমানে যদি বাঁচতে
চাস তো পালা, এ শালা, গুয়ার ব্যাটা হাঁটু থেকে পেট পর্যন্ত ফেঁড়ে দেবে।
যাইহোক সে শুয়োরের
বাচ্চা আমাদেরকে মানুষ বলে মনেই করে নি।
তবু কানুদা আমার
হাতের টেংরিটা একহাতে ধরে আমাকে টেনে নিয়ে চলল পাহাড়চূড়ার দিকে। "য পলায়তি স
জীবতি" এই থিয়োরি নিয়ে।
প্রায় সারাদিন
খাওয়া হয়নি। রাস্তায় চিড়েগুড় শুকনো খাওয়া হয়েছিল। সেসব পেটে কিচ্ছু নেই। ক্যাম্পে
পৌছে দেখি যে যার জটলাকরে বসেছে পলিথিনের উপর। চিড়ে কাঁচালঙ্কা গুড় দিয়ে জমজমাট
ভোজসভা চলেছে। কিন্তু খাবার জল ছিল না। রিজার্ভ যেটুকু জল ছিল তাতে ভাত
ফুটছে। তিনটে বড় মানুষসমান পাথরের আড়ালে উনুন, তাতে ইয়াবড় ডেগচি বসানো। জঙ্গলে
বিশেষত পাহাড়ের উপর আগুন জ্বালালে তা বহুদূর অবধি দেখা যায়, তাই পাথরের আড়াল নিতে
হয়। দিনের বেলায় ধোঁয়াও বিপজ্জনক, কিন্ত রাত্রে সে সমস্যা নেই। চালডাল সব্জী মশলা
সব একসাথে ফুটছে। দলপতি চাঁদুদা ডেমনস্ট্রেশন দিচ্ছেন, আজকে এখানে খাবার তৈরি করা হল। এরপর গ্রামের মানুষ যা দেবে তাই
খেতে হবে। এছাড়া আমরা ঠিক কোন জায়গায় রয়েছি, তার চারপাশে কী কী গ্রাম রয়েছে। সে গ্রামে
কোন কোন মানুষ অ্যাকটিভ সাপোর্টার, পরের দিন আমাদের কী কী করতে হবে, এইসব। আমরা সব
ব্যক্তিগত নোটবুকে তুলে নিচ্ছিলাম। যে বিষয়ে তিনি সবচেয়ে বেশি সচেতন করলেন তা হল
ম্যালেরিয়া। এখানকার মশা মাত্রই অ্যানোফিলিস, এবং ম্যালেরিয়া মানেই ম্যলিগন্যান্ট।
পনের দিনের আগে নিস্তার নেই। আর এখানের ম্যালেরিয়া যে কী ভয়ানক, তা যার না হয়েছে
সে ছাড়া আর কারো সাধ্য নেই সে নরকযন্ত্রণা অনুভব করার। সিমলিপাল এরিয়ায় বছরের
প্রত্যেক বর্ষায় শয়ে শয়ে মানুষ মারা যায়। যারা সেরে ওঠে, তাদের কেউ কেউ পাগল হয়ে
গেছে, এও শুনেছিলাম, পরে চাক্ষুষ করেছি। কাছাকাছির মধ্যে গুরুমহিষানি, বাদামপাহাড়
ও রাইরাঙপুরে হাসপাতাল আছে অবশ্য , সে এখান থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ কিমির কম নয়। আর
সেখানে যে চিকিৎসা হয় তা কহতব্য নয়। আমরা অবশ্য এখানে আসার আগে একটা কোর্স
কুইনাইন(ক্লোরোকুইন) সেবন করেই এসেছি। তবু প্রিভেনশান ইজ বেটার দ্যান কিওর।
প্রিভেনশন বলতে কেবল ওডোমস্। একপেটি ওডোমস্ আনা হয়েছিল কলকাতা থেকে। আবার গ্রামের কোন কোন মানুষকে
দেখেছি জ্বর এলে একটুক্ষণ হুহু হিহি করে কেঁপে মিনিট পাঁচেক পরেই সামলে উঠতে(একেই
বোধয় ভালুকজ্বর বলে)। কোলকাতার এক ডাক্তারের কাছে শুনেছিলাম এদের শরীরে না কি
প্রাকৃতিকভাবেই ম্যালেরিয়ার অ্যান্টিবডি তৈরী হয়ে গেছে। (সেই ডাক্তার এখন কোলকাতার
একটি মেডিক্যাল কলেজের বিভাগীয় দায়িত্বে আছেন, এরকম কাগজে পড়েছি।)
বিরাট বড়মাপের এবং
বড়মনের মানুষ ছিলেন এই ডাক্তার। পৃথিবীতে এরকম নিঃস্বার্থ বিরাটাকার মানুষ কতিপয় দেখেছি,
একে সৌভাগ্যই বলব আমি। তাঁর কথা পরে লালগড় পর্বে বলা যাবে।
শরীরের নানা অংশে
জ্বালা করছিল। হাঁটু ও কনুই ছিঁড়ে গেছে। পিঠের দিকে কী একটা ফুটে আছে মনে হল। জামা
খুলে চাঁদুদা দেখে বললেন, একটা কাঁটা, মন্তা ফলের। মেডিকেল কিট সবার ব্যাগেই থাকে।
অতএব আমার ও কানুদার চিকিৎসা সারা হল। তারপর খাবার জোগাড়।
ইতিমধ্যে আমাদের
সবার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আরো তিনজনের অন্যএকটা টিম ওখানে পৌঁছে গেছে। আমাদের মধ্যে
দুজন গিয়েছিল রাইরাং রোডে ওদের রিসিভ করে আনতে। তখন রাত প্রায় দশটা।
মাওয়িস্ট ক্যাম্প
সম্পর্কে অনেকের ধারণা হল, বনের ভিতর টেন্ট খাটিয়ে এলাহি ব্যাপার। না, আমরা যেখানে
রাত্রে ঘুমোতাম সেটাই ক্যাম্প। প্রত্যেকের কিটব্যাগে সাত বাই তিন এর একখণ্ড পলিথিন
সিট থাকত। ওটাই আসল ক্যাম্প। এই সিটের মধ্যিখানটা ফাঁকা থাকত, তাতে ঢুকে পড়তাম।
রোদ জল বৃষ্টি মশার উৎপাত সবার হাত থেকে রক্ষা করত ঐ পলিথিন। পলিথিনটি সবুজ
হত, কারণ এতে জঙ্গলের ক্যামোফ্লেজ পাওয়া যেত। গেরিলাযুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হল
ক্যামোফ্লেজ।
দু'রকম ক্যামোফ্লেজ
হয়, একটি হল মাও কথিত "জনগনের মধ্যে মাছ যেমন জলে মিশে থাকে"
আর দ্বিতীয়টি হল
প্রকৃতির মধ্যে স্বাভাবিক প্রানীরা সাধারণভাবে যেটা পায়।
চলুক।এই অভিজ্ঞতার ছেঁড়া ছেঁড়া বর্ণনা কিছু কিছু জানি। তোর উপস্থাপনও বেশ চমৎকা। আর বাক্ কেও স্যাল্যুট। এরকম একটি গদ্যকে ষ্থান করে দেবার জন্য। বুকের পাটা লাগে বস্।
উত্তরমুছুন