তৃতীয় পর্ব
৫
রঞ্জনা জানেনা ও
আমাকে কি দিয়ে গেলো। হয়তো কোনোকিছুই প্রয়োজন হয়না আমাদের, আমরা প্রয়োজন তৈরী করি আর অনেকটা জীবন একসাথে নষ্ট করে
ফেলি। এসব কেউ শেখায়না আমাদের , জীবন শিখিয়ে দেয়।
অনেকে আছে যারা দেখে শেখে , আর অনেকে ঠেকে। যারা
দেখে শেখে তারা আর ঠেকেনা। কিন্তু 'আমি' এক অদ্ভুত চরিত্র, যে দেখে শিখলেও হয়তো
কিছুই শিখতে পারেনি , তাই ঠেকতে চলে গেছে।
ঠেকে শেখারও একটা আলাদা মজা আছে। আসলে সবটাই আনন্দময় ভাবে গ্রহণ করতে হয়। জীবনটা
দুঃখেরই , তাতে প্রতিনিয়ত সুখের
সন্ধান করা আমাদের বেঁচে থাকার মূল লক্ষ্য। আমি যখন আগে রামকৃষ্ণ মিশনের হস্টেলে
থাকতাম তখন এক বন্ধু আমায় বলেছিল, "পৃথিবীতে দুঃখ
পাওয়ার মত আনন্দ আর কিছুতেই নেই"।
রঞ্জনা সত্যিই জানেনা
ও আমায় এই স্বল্প সময়ের মধ্যে কি দিয়ে গেলো। আমার এ কাহিনীর পঞ্চম পরিচ্ছেদ লেখার
মূল রসদ ও আমায় দিয়ে গেছে।
ওরা চলে যাওয়ার পর
আমি আবার একা। এত অজস্র মানুষের ভীড়েও মানুষ একা হয়। প্রত্যেকটা মানুষই আসলে একা।
বেশ ভুলে গেছিলাম সব। একটা রঙিন স্বপ্ন এসেছিল যেন। কিন্তু স্বপ্নেরও ভোর হয়। আর
এটা আমার ব্যক্তিগত স্বপ্নটিও নয়। ওহ্, আমার ব্যক্তিগত
স্বপ্ন সমন্ধে তো কিছু লেখা হয়নি। যাকগে, সময় মত লেখা যাবে।
এখন আবার পুনরায় সব মনে পড়ে যাচ্ছে। সেই এক্সপ্রেশন! তখন মনে হয়েছিল, এই এক্সপ্রেশন, এতগুলোর মিশ্রন যার মুখে একসাথে ছাপ ফেলেছে এটা আমি লিখতে
পারবোনা কোনোদিন। এই দৃশ্যটা শুধু 'তার' দেখা উচিৎ ছিল - কিন্তু এই 'তার' কে? হতে পারে ইনিই এই পড়ে
যাওয়া গল্পের নায়িকা! রঞ্জনা আমায় আরোও
স্মৃতি রোমন্থনের ফুলকি জ্বালিয়ে গেছে।
আমার সামনে থেকে এখন
এই শহরের রাস্তা - গাছ - বাড়ি - মানুষ -গাড়ি - ফুচকাওলা সব
ম্যাজিকের মত উবে যাচ্ছে। আমি আবার ফিরে যাচ্ছি ক্লাস টুয়েল্ভে। এই ক্লাসটা আমি
ভুলতে পারবোনা কোনোদিন। সতেরো বছর বয়স টা এত অমায়িক কেটেছে যে তা লিখে বোঝানো
প্রায় অসম্ভব! হয়তো এইসব লিপি সব
আঁধারের জন্যই- না, এবার শূণ্য থেকে শুরু করা যাক।
*
সেবারে সম্রাটদা বিফল
মনোরথ হয়ে ফিরে যাওয়ার পর আমারও কয়েকটা দিন খুব বাজে কেটেছিল। পড়াশোনাতে মনই বসাতে
পারছিলামনা। এদিকে সামনে এইচ.এস। অনেকেই আমার ফলাফলের দিকে হা পিত্যেশ করে চেয়ে
আছে। পরীক্ষায় মিনিমাম ৮০% না পেলে আজকাল আর 'ভালো' স্টুডেন্ট বলা চলেনা। মানুষের মগজে এই নোংরা বিষয়টা যে কে
ঢোকালো কে জানে! পার্সেন্টেজ কি
আমাদের মেধা নির্নয়ে সক্ষম? একটা সামান্য
পার্সেন্টেজ? এই নিয়ে এতো মাতামাতি
চারিদিকে! আমাদের চেয়ে আমাদের
মা বাবারাই ভাবিত বেশি, ছেলে বা মেয়ে যেন এমন Rank করে যাতে পাশের বাড়ির রুনুবৌদির মুখে ঝামা ঘষে দেওয়া যায়! ওদের ছেলে গোল্ডির রেজাল্ট নিয়ে প্রায়ই শোনাতে আসে চ্যাটাং
চ্যাটাং কথা। কিন্তু এই পারিবারিক ঠান্ডা যুদ্ধের মাঝে একটা স্টুডেন্ট কে কি ঠেলে
দেওয়া উচিৎ? সে পড়াশোনা করবে নাকি
যুদ্ধের শরিক হবে? উফ্! মানুষের ব্রেনকে আবার কেঁচে গন্ডুষ না করলে এইসব
ধনতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার অবসান ঘটবেনা। একজন স্টুডেন্ট যেটুকু শ্রম তার পড়াশোনায়
দেবে ততটুকু ফল পাওয়াই বাঞ্ছনীয়, এবং তা নিয়েই খুশি
থাকাটা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এমন ভাবে কি আর কেউ ভাবে! আরো চাই আরো চাই, আরো আরো আরো চাই, ডিমান্ড পাব্লিকের মানে বাবা-মা'র, আর ছেলেমেয়েরা জীবন স্পয়েল্ড করে পিঠ বেঁকিয়ে পড়াশোনা করে
যাবে। নাচের ক্লাস - গানের ক্লাস - তবলার ক্লাস - গিটারের ক্লাস - কম্পিউটার - ক্রিকেট কোচিং - গন্ডাদশেক টিউশনি --- এরপর যদি ছাত্রছাত্রীরা ডিপ্রেশনে চলে যায় তার পুরো দোষ কি
ছাত্রছাত্রীর নিজেরই? এরকম কত প্রশ্ন করা
যায়! আমি এক হিসেবে এলিট
না জন্মে প্রোলেতারিয়েত জন্মেই ভালো করেছি। আমার বাবা তথাকথিত মধ্যবিত্তও নয়, নিম্ন মধ্যবিত্ত। আমার মাত্র দুটো টিউশনি। বাদবাকিটুকু
নিজে পড়াশোনা ও একা একা বিন্দাস বেঁচে থাকার অঢেল সময়। কিন্তু এই অঢেল সময় এখন আর
সুখের কাটছেনা। নক্সালের কথা মাঝেমধ্যেই ভেসে উঠছে মনের মধ্যে। আমি যেতে পারলাম।
এই ২০১৫ সালের নক্সাল, দেখা হলোনা। পুরো
ব্যপারটাই তো থ্রিলিং, জানা হলোনা। যেভাবে
অনেক কিছুই অজানা থেকে যায়।
এইরকম সময়ে আমাদের
জলশহরের কয়েকজনকে শিলিগুড়ির একটি কবিতা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হলো। কবিতা
টবিতা ইলেভেনেও সিরিয়াসলি লিখতামনা। টুয়েল্ভে উঠেই যেন এই ঘোরটা চেপে বসেছে। এবং
আশ্চর্য! সকলে আমার কবিতা
গ্রহণও করছে। বিভিন্ন প্রোগ্রামেও ডাক পাচ্ছি। আলাপ জমেছে অনেকের সাথে।
যেসমস্ত বন্ধুরা
একসাথে লেখামো করি, তারা সেদিন কেউই যেতে
রাজি নয়। কিছু ব্যক্তিগত কাজের অজুহাত দেখিয়ে সবাই কেটে পড়লো। আমার এদিকে জেদ চেপে
গেছে, যাবোই। অগত্যা যদি
তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে --- চলে তো গেলাম। ফোন
করে নিলাম শিলিগুড়ির বন্ধুদের। সেদিন এমনই কেলো, তারাও কোনো কারনে ঐ অনুষ্ঠানে যাচ্ছেনা। আমি ঐ বুড়োটে কবিসভায় একাই
নবজাতকের মতো বসে আছি। কবিতা শুনছি। তবে যত যাই হোক। একা একা কোনো কিছুই বেশিক্ষণ
ভালো লাগেনা।
একটু পরে , আন্দাজ বছর তিরিশেক
বয়সের একটি মহিলা এসে বসলো আমার পাশে। পেছনের দিকে চেয়ার বেশ ফাঁকাই আছে , এবং উনি এসে আমার পাশেই বসলেন। ভদ্রমহিলাকে আড়চোখে দেখে
নিলাম। একদম বিদ্যাবালান। আর কোনো ডেসক্রিপশনের দরকারই পড়েনা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই
আমার কবিতা পাঠের ডাক এলো। গেলাম , পড়লাম , এবং জয়ও করলাম। সবাই
ডেকে ডেকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। আসলে আমার সতেরো বছর বয়সটাই কবিতার অ্যাডভান্টেজ।
এসব সবই বুঝি , তবুও প্রশংসা পেতে কে
না ভালোবাসে! তোষামোদ শেষ হওয়ার পর
যখন নিজের সিটে ফিরে এলাম দেখি সেই ভদ্রমহিলা আমার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে।
আমি লজ্জা লজ্জা মুখ করে বসে পড়লাম। সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও বেশ বুঝতে পারছি
উনি এখনো আমার দিকে চেয়ে আছেন। আমার সদ্য গজানো কচি দাড়িতে একটু হাত বোলালাম। কি
করবো বুঝতে পারছিনা। তাকানোটা এখন অস্বস্তিকর লাগছে। এবার বুঝলাম আমরা ছেলেরা যখন
কোনো মেয়ের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকি তখন তার কিরকম অস্বস্তি লাগে! হঠাৎ উনি নিজেই কথা বললেন ,
"তোমার লেখা আগে
আমি কাগজে পড়েছি। এতক্ষণ নামটা জানতামনা তাই বুঝিনি।"
''আচ্ছা , ধন্যবাদ দিদি।"
"উহুঁ , ধন্যবাদের কি আছে! ওহ্ হাই , আমি রিনিতা।"
"নমষ্কার। আমি
দেবাঞ্জন।"
"হ্যাঁ , জানিতো। বললামনা লেখা পড়েছি। খালি বুঝিনি যে সেই কবিটি এত
ছোট একজন ছেলে।"
বলতে বলতে তিনি হেসে
উঠলেন। এবং এর উত্তরে হাসি ছাড়া আর কি দেওয়া যায় তা আমার সতেরো বছরের মগজ জানেনা।
"কোথায় বাড়ি
শিলিগুড়িতে?"
"না , আমার বাড়ি জলশহরে।"
"অ।"
এভাবে সরে -অ দিয়ে উত্তর দিতে আগে কাউকে
শুনিনি। মজা পেলাম।
"তা আজ এখানেই
থাকছো না ফিরে যাবে?"
"ফিরে যাবো।
নটায় লাস্ট বাস।"
"আর না ফিরতে
পারলে?"
"মানে?" এবার একটু অবাক হলাম।
"মানে যদি এখান
থেকে বেরোতে দেরি হয়ে যায় আর বাস মিস্ হয়ে যায়, তাহলে থাকবে কোথায়?"
"দেখা যাবে।
বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি তো আছেই। নাহলে ..."
"নাহলে?"
"সে দেখা যাবে
ক্ষণ। আগেই অমন ভাবছেন কেন? বাস তো পেয়েও যেতে
পারি , আর পাবোই।"
"হমমমম। অসুবিধা
হলে বোলো। আমার ফোন নাম্বারটা রেখে দাও।"
ভদ্রমহিলা ওর কার্ড
দিলেন। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে আবার কবিতায় মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু টিউনিংটা
কোথাও কেটে গেছে। যেভাবে ভদ্রমহিলা যেচে ফোন নাম্বার দিলেন তাতে করে কেমন যেন একটা
অস্বস্তি শুরু হলো। আমার ইন্টেলেক্ট বলছে , সামথিং ইজ রং।
সবার কবিতা পাঠ শেষ
হলে কবিদেরকে বিরিয়ানি মাংস খাওয়ানো হলো। দারুন ব্যবস্থা। এটা বেশ ভালোই লাগছে।
কবিতা লিখতে এসে তো দেখি হেব্বি লাভ! ফকোটে বিরিয়ানিও জুটে যায়। এগুলোই বোধহয়
কবিতা লেখার ইনকাম। কবিতা উৎসব না বিরিয়ানি উৎসব বোঝা ভার! যেভাবে কবিতা পড়ার
জন্যও সাধা হয়নি ততটা বিরিয়ানি খাওয়ানোতে সাধা হচ্ছে।
আমি ঘড়ি দেখছি আর
খাচ্ছি। সেরেছে! ৮.৩০ বাজে। খেয়ে দেয়ে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে যদি বেরোই
তবে নির্ঘাৎ বাস মিস্ করবো। একবার পকেটে ভদ্রমহিলার নাম্বার লেখা কার্ডটা হাত দিয়ে
অনুভব করলাম। ওকে এই ভোজসভায় কোথাও দেখছিনা। উনিতো এখানকারই মানুষ তাই হয়তো পরের
ব্যাচে খাবেন। দুরের লোকদের আগে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
খাওয়ার সময়েও শান্তি
নেই। অন্যান্য অনেক কবিরা আমার সাথে ডেকে ডেকে কথা বললেন। মেইল আইডি দিলেন তাদের
পত্রিকায় লেখা পাঠানোর জন্য। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে চাইলেন না যে এভাবে এঁঠো হাতে
আমি মেইল আইডি টা টুকবো কোথায়? এবং এসব করতে করতেই শেষ মেশ লাস্ট বাসের টাইম
আপ হয়ে গেলো। নিজেকে কান্ডজ্ঞানহীন সবসময়ই মনে হয়। এখন আরোও বেশি করে
মনে হলো। কেন আমি তাড়া আছে বলে আগে বেরিয়ে এলামনা? জানি যখন সবই! কিন্তু
একটা কেমন যেন লাগে শরীরের ভেতর , মনে হয় সবসময় দোটানায় আছি। ডিসিশন
নিতে পারিনা। এখন যেমন সভা হলের বাইরে রাস্তায় বোকার মত দাঁড়িয়ে
আছি। কি করবো মাথায় আসছেনা। আসলে সব দোষই আমার। আজ যদি না আসতাম তাহলেই
ভালো হত। বন্ধুরা যখন কেউ আসতে চায়নি আমারও আসা উচিৎ হয়নি। এই জেদ জিনিসটা খুব
বাজে।
"কি? সময়
পার হয়ে গেছে তো?"
চমকে তাকালাম পেছনে।
সেই ভদ্রমহিলা! রিনিতা। খুব রাগ হলো ওর ওপর। ওর জন্যই বাস মিস্ করেছি।
হ্যাঁ , ও'ই মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল বাস মিস্ করার ব্যপারটা।
"কি করবে
এখন?"
আরোও গা জ্বলে গেলো
এই কথাটায়। তবুও নিজেকে সংযত করে বললাম , "বুঝছিনা। দেখা যাক কাউকে
বলি , একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে।"
"কাউকে বলার কি
দরকার! আমি তো আছি। চলো আমার বাড়ি।"
আমি ইতস্ততঃ করে
বললাম ," না না , তা কি করে হয়! আপনি আমায় ঠিক করে
চেনেনওনা আর বাড়িতে আশ্রয় ... না না , এটা হয়না।"
"আরে কেন
হয়না? কবিদের আবার ওসব সংস্কার আছে নাকি? কবি হওয়ার তো এটাই মজা। এক
দেখাতেই সকলে আত্মীয় হয়ে যায়। কিচ্ছু হবেনা। চলো। আজ তুমি এমনিতেও বাড়ি ফিরতে
পারবেনা। বাড়িতে চলো , সারারাত কবিতা শুনবো তোমার। ঝোলায় ডায়েরি তো
আছেই!"
এবার আমার নিজের ওপর
রাগ হলো। শিলিগুড়িতে আমার রাতে থাকার জায়গার কোনো অভাব নেই। অনেক আত্মীয়। কিন্তু
আমি কোনো আত্মীয়ের সাথেই মিশতে পারিনা। তাই সবাই দূরের মানুষ হয়ে গেছে। ওদের যে
কারোর বাড়িতে গেলেই ওরা হৈহৈ করে আমায় থাকতে দেবে , খুশিও হবে খুব। কিন্তু
আমি ---
"কি ভাবছো
এত? অতো ভাবার কিছু নেই। বি প্র্যাক্টিক্যাল। এখন জলশহরে ফিরতে পারবেনা। আর
আমাকে কি তোমার খারাপ মনে হচ্ছে? যে যেতে চাইছোনা?"
" না
না , খারাপের কি আছে! ধ্যাৎ , আপনি এমন কথা বলেন
না!"
"তাহলে আর কোনো
বাঁধা নেই? রাস্তার ওইদিকে আমার গাড়ি রাখা আছে। এসো আমার সাথে।"
একবার ওপারের অলটোটা
দেখলাম। অনেক কটা গাড়িই দাঁড়িয়ে আছে। তবে তার মধ্যেও রিনিতা দি'র গাড়িটা বোঝা
যাচ্ছে। ওর মতই ঝকঝক করছে। আমি বাড়িতে একটা ফোন করে দিলাম। তবে বললাম না কোনো
অচেনা নারীর সাথে আমি তার বাড়িতে যাচ্ছি , রাতে থাকবো বলে। বন্ধুর বাড়ির
কথাই বললাম। এবার দেখা যাক ভদ্রমহিলাকে। একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পাচ্ছি। নিজেকে
বেশ সাহসী মনে হচ্ছে। কবিতা লেখার এটা আর একটা পুরস্কার , কোনো সুন্দরী
নারীর বাড়িতে অতিথি হয়ে থাকা। তাও সারারাত! ভাবতেই গায়ে কাটা দিচ্ছে।
**
ভালো স্পিডে গাড়ি
চলছে। মোটামুটি ৭০ কিলোমিটার গতিতে তো বটেই। আমি ড্যাশবোর্ডের দিকে একবার ঝুঁকে
দেখলাম। হ্যাঁ , যা আন্দাজ করেছি তাই। হাত খুব পাকা
রিনিতাদি'র। 'সুন্দরীর সাথে লংড্রাইভে' - এই নামে একটা গল্প লিখতে হবে।
রিনিতাদি'র শরীর থেকে মোহময়ী গন্ধ আসছে একটা। কি পার্ফিউম কে জানে। দামী কোনো
প্রোডাক্ট হবে। চুড়িদার পড়ে আছেন উনি। জানালা দিয়ে হাওয়া ঢুকে খুব সাহসী ভাবে ওর
বুকের কাছের শালোয়ার কাঁপিয়ে যাচ্ছে। উনি চালাতে চালাতেই ওর্নাটা ঠিক করে
নিচ্ছিলেন। আমি পাশে বসে রাস্তা লক্ষ্য করতে করতে আড়চোখে এসবও দেখে নিচ্ছি। এতক্ষন
একটাও কথা বলিনি আমরা। এবার রিনিতাদি গাড়ির ভেতরের নীরবতা ভেঙে বললেন ,
" কিসে পড়ো এখন দেবাঞ্জন?"
"এই এবার
উচ্চমাধ্যমিক দেবো।"
"বাব্বা! তুমিতো
অনেক ছোট! দেখে তাও ভেবেছিলাম একুশ-বাইশ। তুমিতো সতেরো-আঠারো গো!"
আবারও হাসি ছাড়া আর
কোনো উত্তর হয়না এর।
"আমার বয়স কত
বলোতো?" রিনিতাদি'র এই প্রশ্নে আমি চমকে উঠলাম এবার!
"কি
জানি! তবে মা বলে মেয়েদের বয়স শুনতে নেই।"
পুরো শরীর কাঁপিয়ে
রিনিতাদি হেসে উঠলেন এই কথায়। স্টিয়ারিং থেকে হাত ফস্কে যাবে বলে আমার ভয় হলো
রীতিমতো। কিন্তু আগেই বলেছি , উনি বেশ পাকা ড্রাইভার।
"কেন শুনতে হয়না
গো?" হাসতে হাসতেই বললেন উনি।
"তা জানিনা। মা
বলেছে , শুধু এটুকুই জানি।"
"বাপরে! মাতৃভক্ত
একেবারে। আমার বয়স বলা নিয়ে ওসব কোনো কুসংস্কার নেই। বুঝলে? তুমি আমার থেকে
১৬ বছরের ছোট।"
"১৬ বছরের
ছোট! মানে আপনার বয়স ৩৩? আমার আন্দাজের চেয়েও তিন বছর বেশি! দেখে
কিন্তু একেবারেই মনে হয়না যে ---"
"যে? তেত্রিশ
বছর , তো?" একটা ফুল পাঞ্জাব লরিকে ওভার টেক করতে করতে রিনিতা
দি বললেন।
"হ্যাঁ , আসলে
আমি তো ভেবেছিলাম আপনার বয়স ৩০ মত।"
কিছু কিছু মেয়ে থাকে
যারা জানে যে তারা হাসলে তাদের দারুন সুন্দরী লাগে। রিনিতাদিও তাদের মধ্যেই পড়ে।
কথায় কথায় উনি হাসছেন। ইনি কি কবিতা লেখেন? অবশ্য পড়তে তো শুনিনি। হয়তো শুনতে
ভালোবাসে। কবিরা সুন্দরী পাঠিকা পেলে ভালো কবিতা লিখতে পারে।মনে মনে একটু হাসলাম।
রিনিতাদি হেসে হেসে আমার প্রশ্নের কি উত্তর দিলো শোনাই হলোনা শেষমেশ। আমি চুপ করে
যাওয়াতে রিনিতাদিও চুপ করে গেলেন। তারপর আবার কিছুক্ষণ পর
বললেন ," এই শোনো , তুমি আমাকে 'আপনি' বলে
ডাকবেনা। কেমন যেন নিজেকে বেশি বড় বড় লাগে। আসলে বয়স ৩৩ হলেও খুব একটা তো বড়
নই। 'তুমি' করে ডেকো। কেমন?"
রিনিতাদির এই কথা
থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে মেয়েরা বয়স নিয়ে সত্যিই মাথা ঘামায়। খুব একটা বড় তারা হতে
চায়না।
"ঠিক আছে। তুমি
যেমন বলবে।"
"বাহ! এইতো
গুড। ফর্মে চলে এসছো সাথে সাথে।"
ভদ্রমহিলার বাড়ি
কতদূর সেটাই শোনা হয়নি। কারন আমরা তো শিলিগুড়ি প্রায় পেরিয়ে এলাম দেখছি!
"আপনার , থুড়ি , তোমার
বাড়িটা কোন জায়গায় রিনিতাদি?"
"শিব মন্দিরের
কাছে। আর অল্পক্ষণ লাগবে। বোর হচ্ছো নাকি?"
"না
না , এমনি জিজ্ঞেস করলাম।"
***
রাস্তার ধারের দোতলা
বাড়িটা ছোট্ট ও খুব সুন্দর দেখতে। এক টুকরো জমিও আছে সামনে। তাতে ফুলের গাছ ও
পাতাবাহার লাগানো। রিনিতাদি'কে এখন আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে। প্রথমে অস্বস্তি ও
পরে হাল্কা দুষ্টুমির মানসিকতা এলেও এই ফুলের বাগান দেখে আমার ক্লাস ইলেভেনের
নিজের বাগান করার কথা মনে পড়ে গেছে। তখন কবিতা টবিতা লিখতামনা। খালি বই পড়া আর
ফুলের গাছ লাগানোই ছিল নেশা। এই কবিতা আমার অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। যাইহোক কবিতা
যেমন অনেক কিছু কেড়েছে তেমনি দিয়েছেও , যেমন এই আজ --- এখন
প্রায় সাড়ে নটা বাজে। তবে অন্ধকারেও ভালোই দেখা যাচ্ছে বাগানটা। ব্যালকনির আলোটা
বড় রহস্যময় ভাবে পড়েছে গাছ গুলোতে।
"এসো , ভেতরে
এসো দেবাঞ্জন।" রিনিতাদি গাড়িটা গ্যারেজে ঢুকিয়ে এসে দরজার তালা
খুলতে খুলতে বললো।
প্রথমে ভেবেছিলাম
বাড়িতে লোকজন আছে। কিন্তু এ যে একেবারে ফাঁকা বাড়ি! রিনিতাদিই তালা খুলছে।
আচ্ছা ওর বিয়ে হয়নি? আজকালকার মেয়েদের তো শাখা সিঁদুরের বালাই
নেই , তাই বোঝা যাচ্ছেনা নাকি? নাকি বিধবা? নাহলে একটা গোটা
বাড়িতে একা --- উহুঁ , ব্যপারটা কেমন যেন ঠেকছে!
"দাঁড়িয়ে কি
ভাবছো? এসো!"
"হ্যাঁ।" চিন্তায়
ছেদ পড়লো। বারান্দায় চটি খুলে ঘরে ঢুকলাম। ড্রইংরুম টা খুব সুন্দর ভাবে সাজানো।
রিনিতাদি'র রুচিবোধ প্রবল। কি ঝকঝকে করে সাজিয়েছে ঘরটা। দামী
সোফাসেট - ওয়াল পেইন্টিং - ছাদ থেকে একটা মিনি ঝাড়লন্ঠন
ঝুলছে।
"ফ্রেশ হবে
তো? ওই যে বাথরুম , এসো দেখিয়ে দিচ্ছি। ফ্রেশ হয়ে এসে বসো। আমি
ততক্ষনে কফি করে আনি। কফি খাওতো?"
"হ্যাঁ
হ্যাঁ , সব চলে আমার।" বলতে বলতে রিনিতাদি'র দেখানো পথে
বাথরুমের দিকে গেলাম।
বাথরুমে ঢুকে পড়লে
আমরা সবাই রাজা হয়ে যাই। যার যা মনের মধ্যে ঘুরপাক খায় সব প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে।
কেউ কেউ সিঙ্গার হয়ে যায় তো কেউ কেউ আকাশ পাতাল কত কি ভাবে! আমার মাথাও
এতক্ষণে একা হওয়ায় বিভিন্ন কলকব্জা নাড়ানো শুরু করে দিলো। এই যে একদম অপরিচিত একটি
মেয়ের সাথে তার বাড়িতে এলাম রাত কাটানোর জন্য এটা কি ঠিক হলো? তখন ঝোঁকের বশে
ওর কথার জাদুতে রাজি হয়ে গিয়ে কি আমি কোনো ভুল নিজের অজান্তে করে ফেলেছি? রিনিতাদি'র
আসল পরিচয় কি? ওই বা কিরকম মেয়ে যে একজন অপরিচিত ছেলেকে নিজের ফাঁকা বাড়িতে
নিয়ে এলো? ও করেটাই বা কি? উহ্! একা হওয়ার এই এক
জ্বালা , নিজেই নিজেকে কাউন্টার করতে শুরু করি! মাথা ঠান্ডা হওয়া
প্রয়োজন। প্রতিটি পদক্ষেপ ধীরে সুস্থে ফেলতে হবে। এখন যখন চলেই এসেছি এই বাড়িতে
তখন আর কিছু করার নেই। বেসিনের কলটা খুলে মাথাটা নামিয়ে দিলাম তলে। ধুয়ে যাক যত
ক্লেদ , যত উদ্ভট ভাবনা।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে
দেখি রিনিতাদি কফি নিয়ে সোফায় বসে আছে। আমি বাথরুমে বেশ অনেকটা সময় কাটিয়েছি।
এরমধ্যেই রিনিতাদি পোশাক বদলে একটা স্লিভলেস নাইটি পরে নিয়েছে। ওর বিপজ্জনক শরীরের
সঙ্গে এই পোশাক আরোও বিপজ্জনক। আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোনে স্বভাবসুলভ হাসি
ছড়িয়ে রিনিতাদি বললো ,"তুমি তো মেয়েদের মত বাথরুমে অনেকটা সময় লাগাও
গো! হ্যাঁ? "
"না আসলে মাথাটা
ব্যাথা করছিল। তাই জল দিলাম একটু।"
"মাথা ব্যাথা
করছে! কেন? মাইগ্রেনের সমস্যা?"
"না। আমার
সাইনাসের প্রব্লেম আছে। ওরম্ হয় মাঝেমাঝে। SOS নামে একটা হোমিওপ্যাথি
ওষুধ আছে। ওটা খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।"
"আগে কফিটা খেয়ে
নাও , ঠান্ডা হয়ে যাবে এরপর।" বলে কফির কাপটা আমার দিকে এগিয়ে
দিলো। কাপের হ্যান্ডেল ধরার সময় একটু আঙুলের ছোঁয়া লাগলো আমাদের। এটাই প্রথম ছোঁয়া
রিনিতাদি কে।
কাপে চুমুক দিয়ে
রিনিতাদি'র সর্বাঙ্গ একবার স্ক্যান করে নিলাম। কিন্তু কফির স্বাদটা এতো ভালো যে
আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো।
মিথ্যা কথা আমি
সচরাচর বলিনা। সচরাচর কেন , বলিইনা। কিন্তু আজ আমি কেন এরকম
করলাম? নিজের গালে আমার চড় কষাতে ইচ্ছে হলো। এইসব ছোটোখাটো ভুল গুলো আমি
সবসময়ই করে ফেলি। এগুলো কবে শোধরাতে পারবো? একজন মোহময়ী সুন্দরীর বাড়িতে তার
প্রায় খোলামেলা পোশাক পরিহিত শরীরের সামনে বসে আমি কফি খাচ্ছি আর ওর উদ্ধত
নাক-বুকের দিকে নজর দিচ্ছি। বারবার রিপিট হচ্ছে দর্শন। স্লিভলেস নাইটিটা প্রায়
স্বচ্ছ। অন্তর্বাস দেখা যায়। এত পুরুষ্ট সুন্দর বাহু আমি আগে কোনো মেয়ের
দেখিনি! কিন্তু এই সামান্য মোহ আমি কাটাতে পারলামনা? এর জন্য
বাবাকে - মা'কে মিথ্যা বললাম? আমার চেয়ে বয়সে ষোলো বছরের বড় একটি
মেয়ের শরীর নিয়ে জল্পনা কি বিকৃত কামের পরিচয় দেয়না? আমার চোখ পুড়ে
যাক , আমার হাত পুড়ে যাক , আমার ---
"দেবাঞ্জন! কি
হলো? মাথা ঝাঁকাচ্ছো কেন? ব্যাথা করছে খুব?"
আমি প্রকৃতস্থ হলাম
সাথে সাথে। আবেগে বেশি আপ্লুত হয়ে গেছি , তাই ভাবনাটা শরীরে প্রকাশ পেয়ে
গেছে।
"হ্যাঁ , একটু
ব্যাথা তো করছেই , তবে কফিটা খেয়ে একটু ভালো লাগছে।"
"তুমি কফি খেলে
কোথায়? এক চুমুক দিয়েই তো ভাবনায় ডুবে গেলে।"
একটু লজ্জা পেলাম এ
কথায়। কিন্তু কোনো উত্তর দিলামনা। সব সময় সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়না।
"এই তুমি কাউকে
ভালোবাসো , দেবাঞ্জন?"
এরকম সম্পূর্ণ
অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে এবার চমকে গেলাম খুব। এতো প্রগলভতা আমাকে অস্বস্তি দিলো। এরকম
দুম করে কেউ এসব প্রশ্ন করে? কথা হচ্ছিল কি নিয়ে সেটাই মনে করতে পারলামনা।
"হ্যাঁ - মানে - না ---"
"মানে? এটা
কি রকম উত্তর?" গলায় রসিকতা এনে রিনিতাদি বললো।
"মানে
ভালোবাসাবাসিতে আমি আছিও আবার নেইও - আচ্ছা হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন
বলোতো?"
রিনিতাদি মুচকি মুচকি
হেসে বললো , "না , এমনি জিজ্ঞাসা করছি। তোমাদের বয়সী
ছেলেমেয়েরা সদ্য এইসব বিষয় গুলো বুঝতে শেখেতো! তাই তাদের মুখে ভালোবাসাকে
তারা কিভাবে এক্সপেরিয়েন্সড করেছে জানতে খুব ভালো লাগে। তাছাড়া তোমাদের বয়সী
ছেলেরা একটু প্যাশনেটও হয়।"
লজ্জায় লজ্জাপতি
সবসময় মেয়েরাই হয়না , কখনো কখনো অবস্থাগতিকে ছেলেদেরও হতে হয়। যেমন এই
আমি - "প্যশনেট!" ধুর , এটা বাড়াবাড়ি।
"লজ্জা পেলে
নাকি?"
লজ্জা যে পেয়েছি সেটা
আর বলবার মত কিছু নয়। কিন্তু এই নারী তো ধীরে ধীরে অতি রহস্যময়ী হয়ে
উঠছে! এতোদিনে যদি বিয়ে না'ই হয়ে থাকে তবে এবার বাড়ির লোকজনের উচিৎ বিয়েটা
দিয়ে দেওয়া , অবশ্য যদি বাড়ির লোক কেউ থেকে থাকে তো! কেননা রিনিতা
দি'র নাকের ডগার ঘাম আর সমস্ত শরীরের আকুতি অন্যরকম ইঙ্গিতকে স্পষ্ট করেছে। আমার
অস্বস্তিটা আরোও প্রবল হচ্ছে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানাচ্ছে যে এই পরিবেশ আমার পক্ষে খুব
একটা সুখকর নয়।
কফির কাপটা টেবিলে
সশব্দে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালাম।
"কি হলো?"
"আমার শরীরটা
কেমন যেন করছে। আমি একটু বিশ্রাম নিতে চাই।"
"ওহ্ , শিওর! এসো , তোমার
ঘরটা দেখিয়ে দিই।"
রিনিতা দি'র সাথে
ভিতরে যেতে যেতে আমার মনে হল শরীরটা আরোও বেশি করে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
"রেস্ট নাও। আমি
মাথায় বাম লাগিয়ে দিচ্ছি। আরাম পাবে।"
আমি ব্রেনের সাথে কথা
বলা শুরু করলাম , 'আমার কিছু হয় নি , আমি একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক
হয়ে যাবো , কাল আমায় ফিরতে হবে , বাড়িতে ফিরতে
হবে , জলশহরে ফিরতে হবে , আমি সুস্থ
আছি--- আমি ----'
রিনিতাদি'র শরীর থেকে
দেবী প্রতিমার মত গন্ধ ভেসে আসছে , মন্দিরে ঢুকলে এমন গন্ধ
পাওয়া যায় ... কানে ভেসে এলো রিনিতা দি ফিসফিস করে
বলছে ,"শুয়ে পড়ো!"
****
একটা ধবধবে সাদা মাঠ।
মাঠ কখনো সাদা হয়? কিন্তু এটা সাদা। শেষ প্রান্তে একটা মন্দির। আকাশের রং
বলছে এটা গোধূলী। হয়তো গ্রামের দিকে গরুরা এখন ফিরছে। মন্দিরে আলো জ্বলছে। লোকজনে
পরিপূর্ণ একটা গমগম শব্দ। আমি হাঁটা দিলাম। মন্দিরে কেন যাচ্ছি জানিনা। হয়তো কেউ
আমায় অভ্যাসের বশবর্তী হয়ে নিয়ে চলেছে। মন্দিরে পৌঁছে বুঝলাম এটা কোনো রামকৃষ্ণ মিশনের
মন্দির। এখন সন্ধ্যারতি হবে। আশ্রমবাসী ছাত্ররা ধূতি উত্তরীয় পড়ে সামনের দিকে বসে
আছে। পুরো মেঝেটা শতরঞ্জি পাতা। অথচ শতরঞ্জির রংটা আমি দেখতে পাচ্ছিনা। পিছনের
দিকে একটা ফাঁকা জায়গায় বসে পড়লাম। যেখানে রামকৃষ্ণ - সারদা
মা - বিবেকানন্দ এর বিগ্রহ রাখা তার পাশের প্যাসেজ থেকে এবার একজন সাদা
শাড়ি পরিহিত মেয়ে বেরিয়ে এলো। তার শরীরে শুধুই শাড়ি। কোনো ব্লাউজ নেই। মুখটা খুব
চেনা চেনা। একটা অস্বস্তি হওয়া শুরু হল আমার মেয়েটিকে দেখামাত্র। আমি ওকে চিনতে
পারছিনা কেন? শাড়িটা এত টাইট ভাবে আঁকড়ে রয়েছে শরীরে যে সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ
যেন জ্বলজ্বল করছে। আমি বুঝতে পারছি আমার বাঘাযতীন জেগে উঠছেন প্রতিবর্ত ক্রিয়ায়।
একজন তরুণী সন্যাসীনির শরীরী আবেদন আমায় পাগল করে দিচ্ছে। এত গুলো মানুষ বসে আছে
এই প্রার্থনা গৃহে , তবুও কেউ তেমন নজরই দিচ্ছেনা মেয়েটির দিকে। আমাদের
সকলের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি এবার হাত বাড়িয়ে কার কাছে যেন শঙ্খ চাইলো। মেয়েটার
কামানো পরিস্কার বগল আমার চোখ ছুঁয়ে গেল। আমি ধীরে ধীরে উত্তেজিত হয়ে পড়ছি। ওই
নগ্ন বাহু দুটো এত সুন্দর! হঠাৎই অসাবধানতায় মেয়েটির বুকের আঁচল সকলের সামনেই
খসে পড়লো। আমি বাতাবীলেবুর মত পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কমনীয় একজোড়া
নিষিদ্ধ ফল দেখে ফেললাম। অধীর হয়ে উঠছি। ঐ নিষিদ্ধ বস্তুটি স্পর্শের জন্য আমার
শরীর জানান দিচ্ছে। অথচ এতোগুলো মানুষের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই! যেন এই
প্রার্থনাগৃহে মেয়েটির অস্তিত্বই নেই। শুধু আমিই ওকে দেখছি। প্রবল লজ্জায় মেয়েটির
মুখ লাল হয়ে গেল। এতগুলো পুরুষের সামনে নিজের গোপণ অঙ্গ প্রকাশ পেয়ে গেলে যা হয়।
ঝুঁকে শঙ্খ চাইতে চাইতেই সে বুকের আঁচল সামলানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ঘন কৃষ্ণবর্ন
সেই বৃন্ত থেকে যেন এখনই অমৃত ঝড়বে। আমি আর পারছিনা। কে যেন পেছন থেকে আমার চোখ
জোড়া হঠাৎ ঢেকে দিলো হাত দিয়ে। তারপরই আমি আবিষ্কার করলাম আমার শরীরে একটাও সুতো
নেই। আমার চোখ যে হাত দিয়ে ঢেকে দিয়েছে সেই হাত নিশ্চয়ই কোনো নারীর হাত। আমি বুঝতে
পারছি। এত নরম পুরুষের হাত হয়না। সে এবার আমার কপাল এতো সুন্দর করে দাবিয়ে দিতে
লাগলো যেন প্রবল ব্যাথায় আমার মাথা ফেঁটে পড়ছিল। আমার একবারের জন্যও ইচ্ছে হলোনা
আমাকে পেছন থেকে চোখ বুজে দিয়েছে যে তাকে দেখার। আমার সামনের নারীটিকেই আমায় দেখতে
হবে। হবেই। অথচ আমি হাত তুলতে পারছিনা। সেই হাত সরাতে পারছিনা। আমার চোখের সামনে
সব অন্ধকার হয়ে গেছে। একটা খুব মিষ্টি ঝাঁঝালো গন্ধ এবার নাকে ঢুকে
পড়লো , আর মুখে খুব নরম কোনো প্রত্যঙ্গের ছোঁয়া --- আমি
সর্বশক্তি দিয়ে লাফিয়ে উঠলাম এবার , তারপর ----
দেখি ঘেমে নেয়ে একসা
অবস্থা। একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত ঘরে শুয়ে আছি। এটা কোথায়? মাথার কাছে একজন
নারী বসে পরম ভালোবাসায় আমার মাথা টিপে দিচ্ছে। এবার সত্যি সত্যি লাফিয়ে উঠলাম।
না , এটা স্বপ্ন নয়। আমার মাথার কাছে বসে থাকা নারী আর কেউ
নয় , আজই কবিতা সভায় পরিচয় হওয়া মোহময়ী সুন্দরী রিনিতা দি। আমার এখন সেই
বুকের আঁচল খসে পড়া নারীটিরও মুখ মনে পড়ে গেছে। ওফ! আমাকে যৌনতায় উত্তেজিত
করেছে রিনিতা দি! ছিঃ! একটা হাঁটুর বয়সী ছেলের সাথে? আমি এত বড় মহিলা
কে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারি কিন্তু বাস্তবে? চিৎকার করে উঠলাম ,
"হোয়াট ইজ দিস
রিনিতা দি? হোয়াট দ্য হেল আর ইয়ু ডুইং হেয়ার?"
তন্দ্রা কেটে গেলে
যেভাবে মানুষ চমকে ওঠে সেভাবে রিনিতা দি বললো ," মানে? তোমার
তো মাথা ব্যাথা করছিল। তাই তো বাম লাগিয়ে দিচ্ছি। তুমিই তো বললে!"
প্রচন্ড ঘৃণায়
রিনিতাদি'র দিকে তাকালাম। সেই নাইটিটাই পড়ে আছে। চোখেমুখে বিস্ময়! আমি
আর কিছু ভাবতে পারলামনা। মাথার ভেতর থেকে কে যেন বলছে , রান রান
রান , দেবুদা , ইউ হ্যাভ টু ফিনিশ দ্য লাইন।
আর কোনো কথা না বলে
গটগট করে ড্রয়িংরুমে এলাম। যতটা ক্রোধ শরীরে প্রকাশ করা যায় তা দেখিয়ে ঝোলা
ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এলাম বাড়ির বাইরে। তারপর , দৌড়। একটা অনন্ত
দৌড় দিতে হবে আমায়। এখন কটা বাজে জানিনা। এখান থেকে দৌড়ে আমি পালাতে পারবো কিনা
জানিনা। তবে দৌড়তে আমায় হবে। এ জায়গাটা - এই বাড়িটা থেকে যতটা দূরে
পালিয়ে যাওয়া যায় তা আমাকে দেখতেই হবে। আমার কানের পাশ দিয়ে প্রবল গতিতে হাওয়া পাশ
কেটে যাচ্ছে। ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে ছুটছি। দু একটা কুকুর বোধহয় চিৎকার করে উঠলো
আমার মূর্তি দেখে। বড় বড় পাঞ্জাব লরি চলে যাচ্ছে জাতীয় সড়ক
দিয়ে , তারমধ্যে দিয়েই আমি ছুটছি। কোনো কিছু আর বলা হলোনা। সামনে একটা
গাড়ি আসছে।কোনো প্রাইভেট কার সম্ভবত। কিন্তু আমি থামবোনা। এ অনন্ত দৌড় আজ থামবেনা।
রিনিতা দি'র হাত থেকে আমায় পালাতে হবে। সিনেমার নায়কের মত ছুটছি।
প্রাইভেট কারটা একদম আমার সামনে এসে ব্রেক করলো। আমি ওর ওপর দিয়ে স্বপ্ন চালিতের
মত যেতে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়লাম রাস্তায়।
আমার বুক ধরফর করছে।
দুঃস্বপ্ন দেখে চটকা মেরে ঘুম থেকে উঠেই যদি কেউ দৌড়ায় তবে এতটাই দুর্গতি থাকে তার
কপালে।
আমার চোখের
সামনে কালো আকাশের অজস্র ধ্রুবতারা নেমে আসতে লাগলো।
৬
আমি কখন যেন হাঁটতে
হাঁটতে চিন্তা করতে করতে কদমতলায় চলে এসেছি , এবং মাথার ভেতর এত অতীত
ছোটাছুটি করছে যে রেড সিগন্যাল না দেখেই রাস্তা পেরিয়ে গেছি। ট্রাফিক পুলিশটি
আমাকে একটা কাঁচা খিস্তি দিয়ে টেনে আনলো ফুটপাতে। আমি যেন অনেকক্ষণ দম বন্ধ করে
রাখার খেলায় ফার্স্ট হয়েছি এমন ভাবে শ্বাস নিয়ে উঠলাম। আবার বর্তমান গ্রাস করছে।
বাসস্ট্যান্ড থেকে হেঁটে হেঁটে এতদূর চলে এসেছি?
কদমতলা মোড়ে এই সময়ও
রাজ্যের ভীড়। অনেকগুলো শপিংমল গড়ে উঠেছে এখানে। কিন্তু এতগুলো শপিংমলের এই ছোট্ট
শহরের কোনো প্রয়োজনই নেই। ছোট ব্যবসায়ীদের ধূলিস্যাৎ করতে ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টরা
উঠে পড়ে লেগেছে। 'গরীবি হঠাও' মানে গরীবদের ভাত মেরে নিশ্চিহ্ন করে দাও।
ডুয়ার্সে ইদানীং যে হারে চা বাগান বন্ধ হয়েছে সেই হারেরও দ্বিগুণ হারে এইসব শপিংমল
গুলো গজিয়ে উঠেছে। আমার মনে হয় বন্ধ চা বাগানের মালিকেরাই ওখানে বিজনেস টিজনেস
কিছু হবেনা বলে সব টাকা এইসব মলে ইনভেস্ট করতে শুরু করেছে , ইনটেনশনালি।
লাভই লাভ। অল্প সময়ে অধিক মুনাফা। আর খুঁচিয়ে খোঁজ নিলে এও বেরোবে যে সমস্ত শপিংমল
গুলির সিকিউরিটি গার্ডেরা আসলে ঐ সব বন্ধ চাবাগানের শ্রমিকেরাই। আর ওখানকার মেয়েরা
তো সেই কবে থেকেই পাচার হয়ে যাচ্ছে।
দুর্ভাগ্য!
আমি এমন একটা
সময়ে বাস করি যেখানে চারু মজুমদার আগেই মারা গেছেন।
হা করে একটু ভীড়
দেখলাম ফুটপাথ থেকে। যদিও এখানে যেটাকে ফুটপাথ বলছি তা আদতে ফুটপাথ নয়। এখানে কোনো
ফুটপাথই নেই। মোড়ের কোনে আরোও একটা ফুচকার দোকান।প্রচুর কাস্টোমার। সামলানো
যাচ্ছেনা। ফুচকাওলার ব্যস্ততা দেখে খুব ভাল লাগলো হঠাৎ। বাঁ দিক দিয়ে হেঁটে
শান্তিপাড়া যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ইচ্ছে দমন করলাম। ওদিকেই সব শপিংমল গুলো
পড়বে। ঐ এলাকার সামনে দিয়েই যেতে ইচ্ছে করছেনা। এইসময় গ্রাম থেকে উজিয়ে অজস্র লোক
আসে , শপিংমলে ঢুকে শপিং করে , বাড়িতে গিয়ে দেওয়ালের পেরেকে
শপিংমল থেকে পাওয়া ছাপ্পা লাগানো ক্যারিব্যাগ ঝুলিয়ে রাখে, যাতে লোকজন এলে
তাকে বোঝানো যায় , 'হু হু
বাওয়া , আমি "অমুক" মল থেকে ছাড়া জামাকাপড় কিনিই
না।'
এভাবেই গোটা পৃথিবীকে
ক্রমশই কব্জা করে নেবে ক্যাপিটালিজম। আমি আসলে ঐ পান্তা ভাত থেকে ভাবতে ভাবতে
যেখানে এসে পৌঁছলাম তা আমায় যে ভয়ঙ্কর বাস্তবকে ক্রমেই আরোও আরোও প্রকট করে
দিচ্ছে , তা আমার সহ্য হচ্ছেনা। আমি মহাপুরুষ নই , আমি অনেক
কিছুই সহ্য করতে পারিনা। এবং এর জন্য অনেকে আমাকেই সহ্য করতে পারেনা। কিন্তু সেদিন
আমি ভুল ছিলাম। আর কোনোদিন দেখা বা যোগাযোগ করিনি যদিও , তবুও পরে অনুভব
করেছিলাম রিনিতা দি আমায় আসলে যৌনতায় উত্তেজিত করেনি। ওটা একান্তই আমার নিজের
দুর্বল মনের বিকৃত ভাবনা ছিল। একটা হ্যালুসিনেশন কাজ করছিল আমার মধ্যে। প্রতিটি
ঘটনা যদি সঠিক ভাবে অ্যানালিসিস করা যায় তাহলে দেখা যাবে রিনিতাদির কোনো কারনে
আমায় ভালো লেগেছিল এবং অত্যাধিক স্নেহ দেখিয়ে ফেলেছিল। আর আমি এক অস্বস্তিকর পুরুষ
যে কিনা স্নেহ গুলোকে যৌনতা বলে ধরে নিয়ে ওকে ফ্যান্টাসি করে স্বপ্ন দেখে আবার ওর
নামেই দোষ দিয়ে পালিয়েছিলাম! কিন্তু স্বপ্নে তো আমার কোনো হাত
নেই! স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন। তবে ফ্রয়েড বলেছেন স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন
নয় , অবচেতন কামনা বাসনার ছবি। এত বিকৃত কাম আমার? আমি কি সত্যিই
রিনিতাদির থেকে পালাতে চেয়েছিলাম না নিজের থেকে? এ প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেই
নিজেকে সঠিক ভাবে দিতে পারিনা। আমি বেরিয়ে যাওয়ার সময় শেষ বার যখন তাকিয়েছিলাম
রিনিতাদির মুখের দিকে তখন একই সঙ্গে অনেক অনেক কটা এক্সপ্রেশনের মিশ্রন ছিল তাতে - দুঃখ , লজ্জা , রাগ
এবং অপার স্নেহ যা কেউ বোঝেনি বলে ব্যর্থতার একটা চাপা অসন্তোষ। হয়তো ঐ
এক্সপ্রেশনই আমার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল , যার ফলে আমি গাড়ির তলে চাপা
পড়তে পড়তে বাঁচি।
জীবনের সব থেকে বড়
ব্লান্ডার করেছি যেটা এবং যা এখনো আমায় তাড়িয়ে বেড়ায় তা আসলে ঐ ঘটনাটাই , এবং
এতে আজকের আদিবাসী রমনীটির অনেকটা ভূমিকা আছে। এটা রিকল করে এর সলিউশন বের করতে
পারলেই সেই পান্তা ভাতের গড়িয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়াটা কোথাও না কোথাও গিয়ে সার্থক হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন