শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

।। বিশেষ গদ্য : পৌলমী গুহ ।।





বিজনবালা ও ভুল সুরের গান


ডাকনামের নদীটি তখনো ছলো ছলো হয়নি তেমন। প্রত্যেকের ভেতরেই আসা-যাওয়া করেনা বিবাগী বিকেল। এ গল্প সেই সময়ের।
     আসলে প্রতিটা গল্পেরই শুরু থাকে(অন্তত থাকাটা বাধ্যতামূলক!), নাহলে সাত-পাঁচ নেই হঠাৎ গড়গড়িয়ে গল্প শুরু হলো-এমনটা মানাবে না। এটা আমি ভাবলাম। আপনারা কী ভাবেন তাতে গল্পের কিচ্ছুটি যায় আসে না! অতএব এক নিস্তব্ধ বিকেল (অথবা দুপুর) এবং একটি আলোমাখা ধুলোমাখা রাস্তায় এ গল্পের সূত্রপাত।
   ইস যাহ্! ভুলেই গেছি। ওই দেখুন, গল্পের নায়িকার সঙ্গেই আলাপ হলো না। আরে গল্প মানেই তাতে একটা নায়িকা থাকবেই। থাকতেই হবে। নায়ক? না,আমি ফেমিনিস্ট বাপু। শুধু নায়িকাই চাই। এ গল্পেও আছে, নাহলে গল্পটা তো গল্পই হতো না। সত্যি হয়ে যেতো! সত্যি জিনিসে কারোর মন ভরে না। ছেঁদো কথা রেখে আসুন নায়িকার সঙ্গে আলাপটা সেরে ফেলুন। নায়িকা বিজনবালা। ব্যাস্!
বিজনবালাকে আমি চিনিও না। কোনোদিন চিনতাম হয়তো, এখন ভুলে গেছি। হয়তো যে শহরে দেখা হয়েছিলো, সেখানে ছোটোখাটো একটা নদী তখনো বহতা। হয়তো বা ঝিরিঝিরি পাতা তখনো রাস্তায় হাঁটি হাঁটি পা পা করতো। শীতশেষের বিকেল দীর্ঘশ্বাসে তাদের বিরক্তই করতো নির্ঘাত! বিজনবালা সেই শহরেরই কোনো রোদপড়া ঝুম গলিতে দাঁড়াতো। নিয়ম মতো বিজনবালার রূপ বর্ণনার কথা এখানে, কিন্তু যাকে দেখিইনি তার বর্ণনা দেবো কি করে? ধরে নিন। যাকে আপনি বিজনবালা মানতে চান, তাকেই ধরে নিন। ব্যস্ত রাস্তায় গোলাপি সালোয়ার অথবা অফিসফেরতা নীল শাড়ি। বিয়েবাড়ির এক ঝলক বা মুখবইয়ের গজদাঁত। বিজনবালা তাদের একজন হলেও হতে পারে।
      কিন্তু বিজনবালা এদের কেউ হতে চায়নি। এমনকি এই গল্পটাতেও সে থাকতে চায়নি। বা বলা ভালো, সে এই গল্পটা হোক-তাই চাইতো না। সে চোখ বুজলে একটা সবুজ ভেজা মাঠ দেখতে পায়, তাতে আলগোছে বেগুনি ফুল ফুটে থাকে। ওই মাঠের ওপাশে কি আছে, সে তা জানতেই চায়নি। কারণ সব জেনে ফেললে, জানার ভেতরে খন্ড খন্ড খুশির ছোঁয়া থাকবে না। বিজনবালা অখুশি জীবন মোট্টে চায়না।
    আমরা চাইলেই এবার এখানে একজন নায়ককে আনতে পারি। যদিও আমি নায়ক পছন্দ করিনা, কিন্তু এটা তো আর আমার গল্প নয়। বিজনবালার একজন নায়ক থাকলেও থাকতে পারে। ওফ হো! বুঝতে পারছেন না? এটা তো ঘটেই গেছে। আমি বা আপনি চাইলেই তো গল্পটা বদলে যাচ্ছে না। অতএব একজন নায়ক নিঃসাড়ে ঢুকেও গেছে। যদিও এতোদিন পরে তার চশমার ফ্রেম, চোখের বন্দিশ, পাঞ্জাবির হলুদ ধাঁধা কিছুই মনে পড়ে না ঠিক ঠিক। তবু বলতেই হবে তার হাসির তারল্য বিভ্রম জাগাতো বটে।
   তো নায়ক এলেই তো হলো না, তারও একটা গল্প আছে। কিন্তু সে গল্পটা এতোটাই ধোঁয়াটে যে ভেল্কির চাইতেও অবাক লাগবে। তাই আপাতত এটুকুই জানা রইলো এই তরল হাসির নায়ক ও গরল চোখের নায়িকার মিল-টিল হবে না! এমনকি ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে চোখে-চোখেও নয়। মনে তো নয়ই। মন ব্যাপারটাই বাহ্যিক। যুক্তিবাদীরা অনায়াসে পাশ কাটিয়ে যেতে পারেন। শুধু ঢুলুঢুলু চোখের স্বপ্ন দেখা গবেটরাই এ বালাই টেনে বেড়ান। তেমন কেউ কি পাঠক-সমাবেশে আছেন? তবে দুক্কু পাবেন না যেন! এটাই ফ্যাক্ট। অন্তত এ গল্পের নায়িকা সেটা মানে।
   আমার আর এই গল্পে কোনো ভূমিকা নেই। আপনারও নেই বোধহয়। এতক্ষণ ধরে এই সময়টুকু আপনি স্রেফ নষ্ট করলেন। ভালো বাংলায় জলাঞ্জলি দিলেন। আপনি ধরেও নিলেন, আমি একটি বড়োসড়ো হারামি। আমি এরকম ভাবেই আপনাকে ঠকাচ্ছি। সত্যি বলতে কি, আমি তাই। তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। কারণ বিজনবালার নায়ক এবং বিজনবালা উভয়েই জানে, সব গল্পের শেষ হতে নেই। শেষ থেকেই শুরু হতে পারে। আর সেই ছোট্টো ছিদ্র দিয়েই বড়োসড়ো শেষের আশঙ্কা ঢুকে পড়তে চায়। সেখান থেকে শুরু হবে দৌড়! স্বখাত সলিলে ডুবে যাওয়ার আগে সেই দৌড়খানা দৌড়তেই হবে। পেছনে পড়ে থাকবে রোদঢালা গলি আর ঝিরিঝিরি পাতাদের লাশ। নিমফুলি বিকেল আর মনখারাপিয়া হাওয়ার যুগলবন্দি। ভোর হওয়ার আগের শান্ত আকাশ থেকে নেমে আসা রাতভোরের স্বপ্ন।
ডাকনামের নদীটি ছলোছলো হলো বলে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন