শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

।। কবিতা : নৈরিৎ ইমু ।।





কচ্ছপ ও মানবের যাত্রা

শাখাহীন কোন নদীর খোঁজে, চলেছি ছাড়িয়ে মরুদ্যান, তপ্ত পাথরের পাহাড় ডিঙিয়ে, রুক্ষ ধুলারকাল পেরিয়ে, তাতানো বালির উপর, সঙ্গী হয়েছে বুড়ো কচ্ছপ। দোলতে দোলতে স্লো মোশানের মতো, খানিক নেতিয়ে খানিক ছোট্ট মাথাটা তোলে, দূরে ধাঁধা আর ধাঁধা, খালি পায়ে তাল রেখে হাঁটা— সারি খেজুরবৃক্ষ ফেলে, আবার কোথাও খুব ফাঁকা, যেনো জন্মের পথ বালির সাগর, চললাম দুজনে মিলে, শাখাহীন কোন নদীর খোঁজে, মুসাফির বেশ ধরে। যেভাবে তামাম লোকে যাত্রা করে, নিজের ভেতরবাড়ি বহুপথ ঘুরে। ঝাপসা যুগের স্মৃতি— কালো কালো ঘোড়া, তার ভীড়ে ধবধবে একটি শাদা, মুখগুলো নেকাবের আড়ালে রাখা, না জানি দস্যু নাকি বীর যোদ্ধা! কোথাও বালি-সমাধী থেকে উঁকি দিয়ে আছে— জঙধরা বর্ম, ঢাল-তলোয়ার, খর্পর কটকটে এধার ওধার, রক্তক্ষয়ী কোনো সাক্ষ্য ঘটনার, হয়তো জলসা ছিলো সারারাতভর, নৃত্যুমুখর তাঁবু শরাবের পর, কয়লা হয়েছে সব আলোকশিখা, দূরবাহী সংকেতে জাগা ভোরতক, বেপরোয়া নীলের নিচে মরুনির্ভর— সবটা মায়াবী হলো যেনো শুনশান। জনমের শেষে এসে অরণ্য মাঝে, কার আছে গচ্ছিত এর বেশিকিছু? কচ্ছপ মাথা তুলে, চোখ তুলে আর— একবার ফিরে দেখে আমার আকার। পশ্চিমে সূর্য নামে, পূর্ব দখল করে দীর্ঘ ছায়া, ছায়া শুধু আকারের, তার তলে রেখে— বুড়ো কচ্ছপটাকে, চলেছি দুজনে কোনো শাখাহীন নদে। নদীর এমন ভ্রমে খরস্রোত শুনি, আমরা নিরব তবু ধীরে হেঁটে চলি। কচ্ছপ খোলশে ঢাকা, আমার খোলশ নাই কোনো, বিশ্রামকালে তার শক্ত পিঠের নিচে, ঢুকে সে জ্যান্তপাথর যেনো! অসহায় হলে লোকে ঘরকুনো হয়, যেনো বিপদ আসে না ঘরে, বিপদ বাইরে তাড়া করে! আহা শ্রান্ত, বৃদ্ধ ও আহত ব্যাঘ্রও যেমন করুণ চোখে, অসহায় চেয়ে থাকে শুয়ে, থাবার ঝিলিক আর দাঁতের ক্ষুধার আশেপাশে, হরিণছানা যায় নেচে! সন্ধ্যা নিভিয়ে, রাত নামে মরু প্রান্তরে। আকাশে উদিত হয় পুরুষাকৃতি তারা। বহে ঠাণ্ডা হাওয়া, শীতল ধারার মতো কনকনে অনুভবে, ওম পাবো কোথা! বালির ভেতরে গুঁজে থাকা, অর্ধেক পোঁতা আর অর্ধেক পাহারা দেয়া। অস্থিমজ্জা ক্ষয় করে ঘুমানোর ভানে, মানবের সাথে জীবকূলচ্যুত বুড়ো কচ্ছপটা। শাখাহীন নদী কি আমরা পাবো না? না পেলেও যেতে হবে, রাস্তাহীন বালিটিলা ফেলে, কচ্ছপের সাথে৷ তার কুয়াশাবৃত চোখ কতো কথা বলে, নাই সংশয়, বুড়িয়ে গিয়েছি পা-জোড়া ভেঙেচুরে। হাঁটতে পারছি না, ফলে হামাগুড়ি দিই, শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে রাখি জিভে চেটে চেটে! সাইমুমে আটকে গিয়েছি। বালির কবর খুঁড়ে গা ঢাকা দিয়ে, আহা দীর্ঘ আয়ুর কচ্ছপ, আহা নিরাপদ বলয়ের জীবন, ওগো সফর সঙ্গী, ওগো অভিজ্ঞ বন্ধু, এই শ্বাসনালি আটকে গিয়েছে বালুকণায়, শ্বাসকষ্টে উল্টে গিয়েছে চোখ, তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে গেলো, বুক পিটিয়ে কচ্ছপটারে ডাকি— আমার যাত্রা সাঙ্গ, শাখাহীন নদীতে বুঝি সাঁতার দিয়েছি, ডুব দিয়েছি জলের অতলে। নদীর কিনারা ঘেঁষে জীবিকার চিমনিধোঁয়া, শিশুদের কোরাস গাওয়া, হাঁকডাক ভেসে আসে, মায়ের কান্না শোনা যায়। শাখাহীন নদীটিও কাঁদে, অনেক পোয়াতি কচ্ছপ নদীর তলানিতে ছা বিয়োলো। অনেক কচ্ছপছানা আমারে ঘিরে ঘূর্ণি কাটলো। তাণ্ডব থেমে গেলে, কচ্ছপটারে দেখি— খোলশ ছাড়িয়ে ধীরে মাথা আর হাঁসের মতো পা বের করে, বালির ভেতরে হারিয়ে যাওয়া দেহটারে ফেলে, কচ্ছপ হয়তো দীর্ঘশ্বাসের পরে, নিজের যাত্রা শুরু করে, একা একা কোথাও শাখাহীন নদীটির দিকে, দোলতে দোলতে স্লো মোশানে, বুড়ো কচ্ছপ হেঁটে চলে, দিগন্ত আর মরু মিশে আছে যেদিকপানে-

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন