বুধবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

।। ধারাবাহিক স্মৃতিকথা : আমার বাবা ।। বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় ।।





পর্ব : ১১

কবি কালীপদ কোঙার বাবাকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে বলেছিলেন-“মোহিনীমোহনের যেন তিনখানি পা, একটি স্বর্গ, একটি মর্ত এবং অন্যটি পাতাল ছুঁয়ে আছে মজা করে বললেও কথাগুলির সারমর্ম এই যে একই মানুষ নিরলসভাবে দুর্বল শরীর নিয়েও কীভাবে এত দৌড়ঝাঁপ করতে পারেন সদাচঞ্চল দৌড়ে বেড়ানো একজন মানুষকে তুলে ধরতে গিয়ে খুব প্রাসঙ্গিকভাবে তিনি উত্থাপন করেছিলেন কথাগুলি।     
 আসলে বাবার নিত্যদিনের দৌড়ঝাঁপ, কবিতার জন্য আজ কাকদ্বীপ কাল কোচবিহার এই যে পরিভ্রমণ তাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি বলেছিলেন এই কথাগুলোপ্রতিনিয়ত চঞ্চল যে মানুষ তিনি লেখেন কখন?চব্বিশ ঘন্টারই তো দিনরাত শুধু কবিতার ডাকে নয়সম্পাদনার জন্যও বাবাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে দিনের পর দিন   কেতকীর সম্পাদকীয় দপ্তর শিয়ালডাঙ্গায়, পত্রিকা ছাপা হয় বিষ্ণুপুরে (পুরুলিয়া সুনীতি প্রেস থেকে কেতকী মুদ্রণের বিষয়টি তখন বিষ্ণুপুর নিউ বীণাপাণি প্রেসে স্থানান্তরিত হয়েছে, এই বিষয়ে পরে বিশদে বলা হবে) বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে সিরজাম স্টেশন।সে রাস্তা তখন ছিল উঁচু নীচু অসমতল।সাইকেল চালানো যেত না।পাঁচ কিলোমিটার এই দুর্গম রাস্তা বাবা পচিশ মিনিটে হেঁটে দিতেন অনায়াসে। সারাদিনে ট্রেন চলত দুজোড়া।প্রতি রবিবার অথবা ছুটির দিনে সকালের ট্রেন ধরে বিষ্ণুপুর গেলে ফিরতে ফিরতে মাঝরাত। বিষ্ণুপুর স্টেশন থেকে বৈলাপাড়ায় নিউ বীণাপাণি প্রেস।অনেকটাই দূর হেঁটে যাওয়ার পক্ষে। বাবা রিক্সা করতেন না কখনও  বলতেন- রিক্সা চেপে পয়সা নষ্ট করার চেয়ে সেই পয়সা পত্রিকার জন্য ব্যয় করলে আরও সুন্দর হবে কাগজটি। সাত সকালে কোনরকমে  চাট্টি ভাত খেয়ে বেরিয়ে সারাদিন চা আর বিড়ি খেয়েই কাটিয়ে দিতেন।কখনও মন গেলে চপ বা মিষ্টি।সেও খুব কমদিনই।কৃপণতা নয় নিজের ব্যাপারে বাবার ভাবনা ছিল এরকমই।পত্রিকা যদি আরও একটু ছিমছাম আরও সুন্দর করা যায়। ফলে শরীরও বিদ্রোহ করত বিভিন্ন সময়ে।
শুধু কেতকী নয় একই সাথে বাবা তখন যতীন্দ্রনাথ জানা সম্পাদিত কাঁথির নীহার পত্রিকার শিশুদের বিভাগ সম্পাদনা করেন পাশাপাশি  শুভাশিস ত্রিপাঠীর মুগবেড়িয়া পত্রিকার সবুজের আসর দেখাশোনার দায়িত্বও এই দুটি পত্রিকার ছোটদের বিভাগ তখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এখনও মাঝেমাঝে  স্বর্গীয়  শুভাশিস ত্রিপাঠীর ছেলে স্নেহাশিস ত্রিপাঠীর সাথে ফোনে কথা হলে তিনি  পুরানো সেই দিনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন- ‘’ আপনার বাবা মুগবেড়িয়ায় কতবার এসেছেন, আমাদের সাথে  একটা পারিবারিক সম্পর্কই তৈরি হয়েছিল তখন  মনেই হত না বাইরের কেউআমাদের বাড়িই যেন তাঁর বাড়ি। মুগবেড়িয়া যেন তাঁর দ্বিতীয় জন্মস্থান যতীন্দ্রনাথ জানা এবং নীহার পত্রিকার  সাথেও বাবার ঠিক এরকমই সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলকাঁথির কথাও বাবা খুব বলতেন আমাদের ছোটবেলায়।সেসব গল্প আজ আর বিশেষ মনে নেইঅবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার অসংখ্য তরুণ কবি যারা তখন সাতের দশকে লিখতে শুরু করেছিলেন  নীহার পত্রিকার ছোটদের বিভাগের পাতাগুলি পড়তে পড়তে মাঝেমাঝে সেই গল্পগুলির আস্বাদন পাই। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার সাথে তাই বাবার প্রাণের সম্পর্ক, অন্তরের সম্পর্ক কবি শ্যামলকান্তি দাশ, কবি প্রভাত মিশ্র,  সমীরণ মজুমদার , সূর্য নন্দী, কবি বিষ্ণু সামন্ত ,শিখা মাইতি ( তখনও শিখা সামন্ত হননি ) থেকে আরম্ভ করে  মেদিনীপুরের অজস্র  কবির সাথে  বাবার হৃদ্যতার সেই বলয়টি সাতের দশকেই বিকশিত হয়েছিল কবি ও শিল্পী বিষ্ণু সামন্ত সেদিন  ফোনে বলছিলেন-  তখন স্কুলে পড়ি, কতই আর বয়স হবে, সদ্য লেখালেখি শুরু করেছি। নীহার পত্রিকায় ছোটদের বিভাগে লেখা পাঠাতাম, রামনগর থেকে পোষ্ট অফিস ছিল দূরে ।কাদা রাস্তা, কোন যানবাহন চলত না। সেই কাদা রাস্তায় হাফ প্যান্ট পরে  দুমাইল পথ হেঁটে পোস্ট অফিস যেতাম কবে মোহিনীদার চিঠি আসবে। আসতও। যেদিন আসত সেদিন কী আনন্দ হত বলে বোঝাতে পারব না। মনে হত কর্দমাক্ত রাস্তা যেন আর দুর্গম নেই। চিঠিগুলো জমিয়ে রাখতে রাখতে একদিন ভর্তি হয়ে গেল ঘর। আজ হয়ত সব চিঠি যত্নে রাখা নেই। জায়গা বদলের সাথে সাথে অনেককিছু হারিয়ে গেছে।তবু যা আছে তা নিয়ে যখন ভাবতে বসি তখন মনে হয়, আমার মতো অনেককেই তো চিঠি লিখতেন তিনি। সারাদিনে কত চিঠি লিখতেন তাহলে।“ কবি এবং প্রাবন্ধিক প্রভাত মিশ্রও বলেছেন নীহার পত্রিকার ছোটদের পাতা ঘিরে বাবার সাথে গড়ে ওঠা সম্প্রীতির বলয়ের কথা।কবিজীবনের শুরু থেকেই চিঠিপত্রের আদানপ্রদানের মধ্য দিয়ে  কীভাবে আন্তরিক হয়ে উঠেছিল সেই দিনগুলি।  দেখা সাক্ষাতের চেয়েও  চিঠি, শুধু চিঠির ভেতরেই রয়ে গেছে বিভিন্ন সময়ের চিহ্ন।

শুধু তিনখানি পা নয়। চারখানি হাতও । এত লেখা প্রতিদিন লিখে চলা।বই তো মাত্র পঁচিশ।অজস্র কবিতা অগ্রন্থিত রয়ে গেছে  দুপার বাংলার সংখ্যাতীত লিটল ম্যাগাজিনের পাতায়। কেউ চিঠি লিখলেই তার প্রত্যুত্তর দেওয়া। কেউ পত্রিকা পাঠালে চিঠি লিখে মতামত লিখে তাঁকে জানানো।কেউ বই পাঠালে তাঁকে প্রতিক্রিয়া জানাতেই হবে।নতুন পত্রিকা যা হয়তো জন্মলাভ করেনি তখনও।প্রথম সংখ্যা বার করার তোড়জোড় চলছে । পোস্টকার্ডে একটা ছোট চিঠি এসেছে লেখা চেয়ে।হতাশ হতেন না সেই সম্পাদকও । ছোটকাগজের সাথে যুক্ত কাওকে ফিরিয়ে দেওয়া বা প্রত্যাখান করা ছিল বাবার চরিত্রের বিরোধী। এই বিষয়ে অনেকেই অনুযোগ করতেন- আপনি যেখানে সেখানে লেখেন কেন ? যে যখন চায় দিয়ে দেন।ঘোরাতে পারেন না দশবার ?এতে ওরা আপনার লেখার গুরুত্ব বুঝতে পারবে না, মূল্য বুঝতে পারবে।
কী লিখব এই প্রশ্নটি যেমন বাবার কাছে জরুরি ছিল। তার চেয়েও জরুরি ছিল কোথায় লিখব। যে জায়গাগুলো প্রতিক্রিয়ার ঘাঁটি।যারা স্থিতসাম্যের পক্ষে এবং মানবতাবিরোধী।যারা প্রকাশ্যেই শিল্পীস্বাধীনতা নামক মূল্যবান শর্তটিকে খুন করে।এবং যেখানে লেখকের নিজস্ব স্বর মালিকের অঙ্গুলিনির্দেশে চিরকালের মতো শৃঙ্খলিত হয়ে যায়।এবং এই আনুগত্যের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠান মুমূর্ষু লেখকদের ব্যক্তিগত আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করেতাঁদের আনন্দ প্রদানের বন্দোবস্ত জারি রাখে এবং প্রভুভক্তির স্মারক হিসেবে কবিদের অতৃপ্ত বাসনাগুলির দায়ভার নেয় বাবা তো লেখেননি এসব কাগজে শুধু চরিত্রবান ঋজু কাগজগুলির পাশেই থাকতে চেয়েছেন চিরকাল একটি রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাস করলেও যখনই বিচ্যুতি দেখেছেন তখনই প্রতিবাদ করেছেন। আপস করেননি। বলেছেন- একজন সত্যিকারের কবির গলায় কোন বকলস থাকবে না। ক্ষমতা যেন কবির অন্তরে চিরজাগরুক প্রতিবাদের স্বর কেড়ে নিতে না পারে। কোন অবস্থাতেই যেন ঠোঁট ও কলম বেঁকে না যায়।ফলে কবিতার মতো কণ্ঠস্বরকেও হতে হবে বজ্রনির্ঘোষ।
এখন রাজ্য জুড়ে প্রচুর সিভিক কবি।তাঁরা লেজ নাড়ছেন আনন্দে।রাজসভা ধন্য করার গৌরবে ফেটে পড়ছেন। এইসব  সিভিক কবিরা  অন্তরের আকুতি থেকে নয়,যন্ত্রণা থেকে নয়,হৃদয়ের শুদ্ধতম চেতনার বহিঃপ্রকাশ থেকে নয়  ক্ষমতার অনুপ্রেরণায় অনুপ্রানিত হয়ে তাঁরা কবিতা লিখছেন কবিতা পড়ছেন। নির্ভীক করছেন্র বিপরীতে সিভিক কবিতার এই যে  উন্মাদনা তা দেখে  শিহরিত হতে হয় আমাদের।প্রাতিষ্ঠানিক এবং সামাজিক আধিপত্যবাদের পায়ের তলায় লুটিয়ে গেছে শিরদাঁড়া।কোন উচ্চারণ নেই, অথচ উচ্চারণের নিরন্তর নির্মাণই তো একজন কবির ভবিতব্য।     

হাত, পা এবং গলার স্বর এই তিনটে জিনিষই বাবার আইডেন্টিটি।ফিসফিস করে বাবাকে কখনও কথা বলতে শুনিনি। যা বলতেন জোরেই। এক মাইল দূরের লোক যা শুনতে পাবে স্বচ্ছন্দ্যে।কারোও নিন্দা পছন্দ করতেন না। যা বলার সামনেই মুখের উপর বলে দিতেন। পরে আফসোস করতেন, বলাটা বোধহয় ঠিক হল না।  সেরিব্রাল স্ট্রোক বাবার এই তিনটে জায়গাতেই আঘাত করল। লেখা বন্ধ হল। দ্রুতগতিতে হেঁটে যাওয়া পা কেমন ধীর ও নিঃসাড় হয়ে গেল। গলা অস্পষ্ট জড়ানো। তবু আজও শিরদাঁড়া ঝুঁকে যায়নি।
                                                            ( চলবে)

1 টি মন্তব্য: